ভুগোলে এমএ-বিএড, সংসার চালাতে লোকাল ট্রেনে পোশাক বেচেন বৃষ্টি

ভুগোলে এমএ-বিএড, সংসার চালাতে লোকাল ট্রেনে পোশাক বেচেন বৃষ্টি

বিষ্ণুপুর: শিক্ষাগত যোগ্যতার মাপকাঠিতে তিনি অনেকটাই এগিয়ে৷ ভুগোলে এমএ করার পর পাশ করেছেন বিএড৷ কিন্তু, প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌড়ে তিনি ‘ব্যর্থ’৷ যোগ্যতা থাকলেও মেলেনি চাকরি৷ তাবলে হার মানেননি বৃষ্টি৷ অদমনীয় মনোভাব নিয়ে এক কঠিন লড়াই চালিয়ে গিয়েছেন৷ আর তার এই লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরা৷ চাকরির আশায় ঘরে বসে না থেকে শুরু করেন হকারি৷ ট্রেনের নিত্য যাত্রীদের কাছে পোশাক বেচেই চলে তাঁর সংসার৷ 

আরও পড়ুন- প্রয়াত মন্ত্রী সুব্রতর বিধানসভার ঘরে কে বসবেন? জল্পনা

বৃষ্টির আসল নাম সুপ্রিয়া পাল৷ উচ্চ শিক্ষিত মেয়ের জীবন সংগ্রামকে কুর্নিশ জানিয়েছে তাঁর পরিচিত সকলেই৷ তালডাংরার সাবড়াকোণের বৃষ্টি পাল ওরফে সুপ্রিয়ার সাফ কথা, কোনও কাজই ছোট বড় হয় না৷ সৎ পথে পরিবারের জন্য রোজগার করাটাই বড় কথা৷ প্রতিদিন বাঁকুড়া থেকে মেদিনীপুর শাখার লোকাল ট্রেনের লেডিস কামরায় ফেরি করেন বৃষ্টি৷ ডেলি প্যাসেঞ্জাররা তাঁকে এই নামেই চেনেন। বাড়িতে স্বামী ও শাশুড়ি ছাড়াও রয়েছে সাড়ে সাত বছরের ছোট্ট মেয়ে৷ তাঁদের নিয়েই সংসার বছর বত্রিশের সুপ্রিয়ার। প্রতিদিন সকালে বাড়ির কাজ সামলে সাবড়াকোণ থেকে বাসে করে পিয়ারডোবা স্টেশনে আসেন। সেখান থেকে কোনওদিন মেদিনীপুর, আবার কোনওদিন বাঁকুড়া পর্যন্ত যান। তাঁর কাছে মূলত শিশু ও মেয়েদের পোশাকই পাওয়া যায়৷ লোকাল ট্রেনের ডেলি প্যাসেঞ্জারাই বৃষ্টির মূল ক্রেতা। 

জীবনের পথ বরাবরই ছিল কন্টকময়৷ উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার ঠিক আগে বাবার ক্যান্সার ধরা পড়ে। পরিবারের বড় মেয়ে হিসাবে সংসারের দায়িত্ব গিয়ে পড়ে তাঁর কাঁধেই৷ সেই তখন থেকেই খেটে খাওয়া শুরু৷ আশেপাশের গ্রামে ঘুরে ঘুরে মেয়েদের পোশাক বিক্রি করে সংসার চালাতে শুরু করেন বৃষ্টি৷ নিজের উপার্জনেই চলতে থাকে কলেজের পাঠ৷ ২০১১ সালে বিয়ে হয়ে যায় তাঁর। তবে বিয়ের পরেও পড়াশোনা বন্ধ করেননি। ভূগোলে এমএ পাশ করার পর ২০১৪ সালে বিএড করেন। 

বিয়ের পরেও ধরা দেয়নি সুখ৷ শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার পরেও একইভাবে লড়াই করতে হয়েছে বৃষ্টিকে৷ শ্বশুরমশাইয়ের মৃত্যুর পর পারিবারিক ব্যবসা লাটে ওঠে৷ স্বামী পার্থসারথি পাল সেই সময় একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করতেন। সেটাও আচমকা বন্ধ হয়ে যায়। সংসারে শুরু হয় চরম টানাটানি৷ এরই মধ্যে তাঁর কোল আলো করে আসে ফুটফুটে মেয়ে এনাক্ষী। কিন্তু, সংসার চলবে কী ভাবে? এই চিন্তা ঘুম কেড়েছিল বৃষ্টির৷ সংসারের হাল ধরতে ছোট্ট মেয়েকে শাশুড়ির কাছে রেখেই সাহস করে নেমে পড়েন পুরনো ব্যবসায়৷ তবে এবার আর গ্রামে ঘুরে নয়, ব্যবসা শুরু করেন লোকাল ট্রেনের মহিলা কামরায়৷ প্রতিদিন শাড়ি, চুড়িদার, প্লাজো, পাটিয়ালা, টপ ও শিশুদের বিভিন্ন পোশাক নিয়ে উঠে পড়েন ট্রেনে৷ স্ত্রীর এই যুদ্ধে পাশে থেকেছে তাঁর স্বামী৷ তাঁর কথায়, দিন রাত পরিশ্রম করে সংসারটাকে গভীর খাদ থেকে টেনে তুলেছে ও। ওঁর জন্য আমার গর্ব হয়।   

আবেগ ভরা কণ্ঠে বৃষ্টি বলেন, একদিন এমন দিন গিয়েছে যখন  লোকের কাছে চাল ধার করে এনে ভাত ফুটিয়ে খেয়েছি। ছোট্ট মেয়েটাকে ভালোমন্দ খাওয়াতে পারিনি৷ আজ সেই পরিস্থিতি অনেকটাই বদলে গিয়েছে৷ হকারির কাজকে ছোট না বড়, সেই তুল্যমূল্যের বিচার করিনি বলেই আজ স্বাবলম্বী হতে পেরেছি। এটাই আমার ও আমার পরিবারের কাছে পরম প্রাপ্তি।