কলকাতা: দুর্নীতি। বিগত কয়েক বছর ধরে বঙ্গ রাজনীতি প্রতি মুহূর্তে যেন আবর্তিত হচ্ছে এই ছোট্ট শব্দটিকে ঘিরে। বিরোধীদের অভিযোগ, আবাস যোজনা-সহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে তৃণমূলের একশ্রেণির নেতাকর্মীরা সীমাহীন দুর্নীতি করেছেন। এছাড়া কয়লা পাচার, গরু পাচার তো আছেই। কিন্তু গ্রাম বাংলার মানুষ সরাসরি প্রতিক্রিয়া জানিয়ে থাকেন আবাস যোজনার দুর্নীতি, একশো দিনের কাজের টাকা না পাওয়া, শৌচালয় তৈরির টাকা না পাওয়া, পানীয় জলের সুবন্দোবস্ত না হওয়া ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়ে। তাই পঞ্চায়েত নির্বাচনে গ্রামবাংলার মানুষ তৃণমূলকে এবার উচিত শিক্ষা দেবেন বলে বিরোধীদের দাবি। উল্লেখ্য একশো দিনের কাজের টাকার ক্ষেত্রে খরচের যে হিসেব কেন্দ্রকে দেওয়ার কথা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের, তা নবান্ন দেয়নি বলেই দিল্লি টাকা পাঠানো বন্ধ করেছে বলে দাবি বিজেপির।
একই কথা একাধিকবার বলতে শোনা গিয়েছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী গিরিরাজ সিং-সহ অন্যান্য কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের। অন্যদিকে তৃণমূলের বক্তব্য তাদের বঞ্চনা করছে কেন্দ্র। তবে তৃণমূল বিষয়টি নিয়ে বিজেপির দিকে যতই অভিযোগের আঙুল তুলুক না কেন, সেটা যে গ্রামবাংলার প্রত্যেকেই বিশ্বাস করছেন তা কিন্তু বলা যাবে না। ‘ডাল মে কুছ কালা হ্যায়’, এই অবিশ্বাস বা সন্দেহের বাতাবরণ কিন্তু বহুদিন ধরেই তৈরি হয়েছে গ্রামাঞ্চলের একটা বড় অংশের মানুষের মধ্যে। এই আবহের মধ্যে ৮ জুলাই হতে চলেছে পঞ্চায়েত নির্বাচন। আর সেই নির্বাচনে শুধু মনোনয়ন পর্বেই ব্যাপক হিংসা ছড়িয়েছে বহু জেলায়।
সেই হিংসা কেড়ে নিয়েছে বহু তাজা প্রাণ। এছাড়া মনোনয়ন প্রত্যাহার করার জন্য বহু বিরোধী প্রার্থীকে তৃণমূল চাপ দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। যে রক্তক্ষয়ী মনোনয়ন পর্ব দেখল বাংলার মানুষ, এমনটা যে হবে তা কেউ ভাবতেও পারেননি। তাই নজিরবিহীন ভাবে রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস ‘পিস রুম’ খুলেছেন রাজভবনে। যে বিষয়টিকে কটাক্ষ করছে তৃণমূল। কিন্তু বাংলার একটা বড় অংশের মানুষ এই প্রশ্ন করছেন যে, রাজ্যপাল সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে যদি এমন পদক্ষেপ করেন তাতে তৃণমূলের আপত্তি তোলার কি আছে? তবে কি তৃণমূল সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন হোক এটা চায় না?
এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠছে। আর তার ভিত্তিতেই রাজনৈতিক মহল মনে করছে এই সমস্ত বিষয় নিয়ে গ্রামবাংলার একটা বড় অংশের মানুষ এবার হয়ত ‘জেগে উঠে’ তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে কড়া বার্তা দেবেন। বলাবাহুল্য বিষয়টি নিয়ে বেশ চিন্তিত তৃণমূল। তাই বিরোধীদের পাশাপাশি রাজ্যপালকে নিশানা করে তৃণমূল নেতাদের চড়া সুরে কড়া শব্দবন্ধ ব্যবহার করে আক্রমণ শানাতে দেখা যাচ্ছে। রাজনীতি কারবারিদের একাংশ মনে করছেন এতেই বোঝা যাচ্ছে তৃণমূল পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কতটা ভয় পাচ্ছে।
দশ মাস পর লোকসভা নির্বাচন। তার আগে পঞ্চায়েত নির্বাচন তৃণমূলের কাছে যে বড় মাপের অ্যাসিড টেস্ট, সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির পাশাপাশি কয়লা পাচার, গরু পাচার কাণ্ডের পর সাগরদিঘিতে যে উপনির্বাচন হয়েছে তাতে তৃণমূল বড় ব্যবধানে হেরে গিয়েছে কংগ্রেসের কাছে। কংগ্রেসের জয়ী প্রার্থী বাইরন বিশ্বাস দলবদল করে তৃণমূলে গেলেও তা সাগরদিঘির পাশাপাশি গোটা মুর্শিদাবাদ জেলার মানুষ যে ভাল চোখে দেখছেন না সেটা স্পষ্ট। এই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েত নির্বাচন নিয়ে যে তৃণমূলের অস্বস্তি থাকবে সেটা বোঝাই যায়।
এত দুর্নীতির অভিযোগের পাশাপাশি মনোনয়ন পর্ব ঘিরে বেলাগাম সন্ত্রাস, এর কিছুটা প্রভাবও যদি পঞ্চায়েত নির্বাচনে পরে তবে তৃণমূলের ফল অনেকটাই খারাপ হবে বলে রাজনীতির কারবারিরা মনে করছেন। বিরোধীদের দাবি এবার গ্রাম বাংলার মানুষ জেগে উঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তাঁদের রায় জানিয়ে দেবেন। আর সেই আশঙ্কা থেকে তৃণমূলও গ্রামবাসীদের মন বোঝার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। সেই অনুযায়ী জোড়াফুল শিবির ঠিক করেছে প্রচারের কৌশল। তাতে কতটা ড্যামেজ কন্ট্রোল হয় সেটাই দেখার।