প্রস্তাব পাশ! বিধান পরিষদ গঠনে এত জোর কেন মমতার?

প্রস্তাব পাশ! বিধান পরিষদ গঠনে এত জোর কেন মমতার?

কলকাতা: বাংলার বিধানসভা নির্বাচনের জন্য যে দিন তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের প্রার্থী তালিকা ঘোষণা করেছিলেন, সেদিন তিনি ঘোষণা করেছিলেন বিধান পরিষদের কথা। জানানো হয়েছিল, যাদেরকে তিনি প্রার্থী করলেন না তাদেরকে পরবর্তী ক্ষেত্রে বিধান পরিষদ গঠন করে সদস্য করা হবে। ভোটের আগে যে প্রতিশ্রুতি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দিয়েছিলেন আজ সেই প্রতিশ্রুতি পূরণে অনেকটা এগিয়ে গেলেন তিনি। কারণ এদিন বিধানসভায় বিধান পরিষদ গঠনের প্রস্তাব পাশ হয়ে গিয়েছে। ভোটাভুটিতে পাশ হয়েছে বিধান পরিষদ গঠন প্রস্তাব। এদিন বিধানসভায় উপস্থিত ছিলেন ২৬৫ জন বিধায়ক। বিধান পরিষদ গঠনের পক্ষে ভোট পড়েছে ১৯৬ টি এবং বিপক্ষে ভোট পড়েছে ৬৯ টি। কিন্তু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন এত জোর দিচ্ছেন বিধান পরিষদ গঠনে, এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই উঠতে শুরু করেছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির জন্য গোটা দেশ এবং রাজ্য সঙ্কটে রয়েছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসার পর এবং শপথ গ্রহণ করার আগে থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্পষ্ট জানিয়েছিলেন যে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতি মোকাবিলা করা হবে এই সরকারের প্রথম কাজ। সেই কাজ এখনও চূড়ান্ত রূপ নেয়নি কিন্তু তার মধ্যেই বিধান পরিষদ গঠনের তোড়জোড় শুরু। 

একদিকে যখন করোনাভাইরাস দ্বিতীয় ঢেউয়ে তোলপাড় ছিল দেশ ঠিক তখন কেন্দ্রীয় সরকারের সেন্ট্রাল ভিস্তা প্রকল্প নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা শুরু করেছিল বিরোধী দলগুলি। সেই বিরোধী দলের অন্যতম ছিল তৃণমূল কংগ্রেস। ‌বিরোধীদের বক্তব্য ছিল, যখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের নাজেহাল অবস্থা এবং অক্সিজেনের অভাবে একই সঙ্গে পরিকাঠামোর অভাবে মানুষ মারা যাচ্ছে তখন কেন্দ্রীয় সরকার কী ভাবে সেন্ট্রাল ভিস্তার কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের কাজ নিয়ে এখনো পর্যন্ত কেন্দ্রকে নিশানা করছে বিরোধীরা। স্বাভাবিকভাবেই দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন উঠছে যে কেন্দ্রীয় সরকারের জন্য সবথেকে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে নতুন সংসদ ভবন? যদিও কেন্দ্রীয় সরকারের দাবি করেছিল যে, দেশের করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামলাতে কোনরকম সময় নষ্ট করা হচ্ছে, বরং সব ক্ষেত্রেই সমান ভাবে কাজ করা হচ্ছে। সেন্ট্রাল ভিস্তার কাজ হচ্ছে মানে এই নয় দেশের সরকার করোনাভাইরাস পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছে না। যদিও এই নিয়ে বিতর্ক এখনো বহাল রয়েছে। এবার তার মধ্যেই পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ গঠন নিয়ে হৈচৈ শুরু। কেন্দ্রীয় সরকারের সমালোচনা করা রাজ্য সরকার এখন করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে বিধান পরিষদ গঠনের বেশি জোর দিচ্ছে। কিন্তু কেন হঠাৎ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিধান পরিষদ গঠন করতে এত উদ্যোগী হলেন, তা অবশ্যই বোঝার চেষ্টা করতে হবে।

আরও পড়ুন- শুভেন্দুর শব্দচয়নে আপত্তি স্পিকারের! ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগানে উত্তাল বিধানসভা, বয়কট

প্রথমে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে যে, উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিহার, তেলেঙ্গানা, কর্নাটকে বিধান পরিষদ রয়েছে। আর পশ্চিমবঙ্গে কোন দিন বিধান পরিষদ ছিল না এমনটা নয়। ১৯৫২ সালে বিধানসভায় পাশাপাশি বিধান পরিষদ গঠিত হয় কিন্তু ১৯৬৯ সালে তার অবলুপ্তি ঘটে। কিন্তু এখন আবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিধান পরিষদ গঠন করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছেন। খেয়াল করার মতো বিষয় হল, যে সমস্ত রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ভোটে দারিয়ে জেতেন না অথচ তাদের আইনসভার সদস্য করতে হয় তাদের পাঠানো হয় বিধান পরিষদে। অর্থাৎ নির্বাচনে না জিতলেও প্রশাসনের মুখ্য ভূমিকা পালন করা যায় এই বিধান পরিষদের জন্য। উল্লেখ্য, মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী উদ্ধব ঠাকরে থেকে শুরু করে উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বিধান পরিষদের সদস্য। উদ্ধব ঠাকরে মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পর বিধান পরিষদের সদস্য হয়েছেন, তাই তাঁকে নির্বাচনে দাঁড়াতে বা জিততে হয়নি। এদিকে যোগী আদিত্যনাথও বিধানসভার নির্বাচনে প্রার্থী ছিলেন না। অতএব বোঝা যাচ্ছে, যারা বিধান পরিষদের সদস্য হবেন তাদের ক্ষেত্রে নির্বাচনে জেতা উল্লেখযোগ্য ব্যাপার হবে না। যদিও এই কারণ ছাড়া বিধান পরিষদের আর কোনও উপযোগিতা নেই বললেই চলে। এদিকে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নির্বাচনে জেতেননি। প্রথমে মনে করা হয়েছিল তিনি হয়তো বিধান পরিষদ গঠনের জোর দিচ্ছেন এই কারণেই কিন্তু পরবর্তী ক্ষেত্রে অনুমান করা হচ্ছে যে তিনি ভবানীপুর থেকে উপ নির্বাচনে লড়বেন। তাহলে শুধুই কি প্রতিশ্রুতি পালনের জন্য বিধান পরিষদ গঠন করতে চাইছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? এটাও কি তাহলে তাঁর কাছে রাজনৈতিক অস্ত্র? বিশ্লেষণের জায়গা রয়েছে।

আরও পড়ুন- জ্বালানির দাম কমবে কীভাবে? মমতাকে ‘বোঝাল’ বিজেপি

কেন্দ্রের সেন্ট্রাল ভিস্তা নিয়ে যে ধরনের সমালোচনা হয়েছে তা হয়তো বিধান পরিষদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হতে পারে। কারণ বিধান পরিষদ গঠন হলে তা চালানোর জন্য বছরে প্রচুর টাকা খরচ হবে এবং স্বাভাবিক ভাবেই সেই টাকা আসবে জনগণের পকেট থেকেই। তাই যে নেতা এবং নেত্রীদের সরকারি পদ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে তাদের এইভাবে বিধান পরিষদের সদস্য করে সেটা চালানো কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে তর্ক করা যায়। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির জন্য গত দু’বছর ধরে রাজ্যের এবং দেশের অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অবস্থা খারাপ হয়েছে। প্রচুর মানুষের চাকরি চলে গিয়েছে এবং দৈনন্দিন জীবনে প্রত্যেকের সমস্যা হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বাকি সবকিছু কার্যত অবহেলা করে হঠাৎ বিধান পরিষদের ক্ষেত্রে গুরুত্ব দেওয়া সরকারের পক্ষে কতটা সমীচীন তা নির্ধারণ করা এই মুহূর্তে হয়তো সম্ভব হবে না।

আরও পড়ুন- বিধানসভায় তৃণমূলের ভাষা সন্ত্রাস, অধ্যক্ষকে ‘দলদাস’ বলে তোপ শুভেন্দুর

তবে বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ হলেও বিধান পরিষদ গঠন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পক্ষে একেবারে জল-ভাত হবে না। কারণ এর জন্য অনুমোদন লাগবে কেন্দ্রীয় সরকারের। ‌তারও আগে বিধানসভায় পাশ হওয়া বিল অনুমোদিত করতে হবে রাজ্যপালকে। পরবর্তী ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতি সেই বিলে সই করলে‌ পশ্চিমবঙ্গে বিধান পরিষদ গঠন হবে। কিন্তু এখন থেকেই বিজেপি শিবির এই বিধান পরিষদ গঠনের বিরোধিতা করছে। তাই অবশ্যই পাবে বাংলায় বিধান পরিষদ গঠন খুব একটা সহজ কাজ হবে না তৃণমূল কংগ্রেস সরকারের পক্ষে। তবে রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, বিধান পরিষদ গঠন করতে না দিলেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এদিকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন ভবিষ্যতে। কারণ একাধিক বিজেপি শাসিত রাজ্যে বিধান পরিষদ রয়েছে তাই বিজেপি বা কেন্দ্রীয় সরকার যদি পশ্চিমবঙ্গের বিধান পরিষদ গঠন করতে না দেয় তাহলে বাংলাকে আরো একবার বঞ্চনা করা হচ্ছে এই অভিযোগ তুলে সরব হতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশাপাশি তিনি এও দাবি করতে পারেন যে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি হিসেবে তিনি বিধান পরিষদের কথা বলেছিলেন এবং পরবর্তী ক্ষেত্রে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন তিনি। তাই কেন্দ্রীয় সরকার যদি এই বিধান পরিষদ গঠন করার অনুমতি না দেয় তাহলে বাংলার মানুষ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাকে অপমান করা হবে। 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

eighteen − 4 =