এই বাঙালি চিকিৎসকের আবিষ্কারই প্রাণ বাঁচিয়েছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর

এই বাঙালি চিকিৎসকের আবিষ্কারই প্রাণ বাঁচিয়েছিল ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর

কলকাতা: নিরন্তর বয়ে চলা সময়ের স্রোতে ভেসে যায় কত স্মৃতি৷ কিছু ঘটনা চিরকাল স্মরণে থেকে যায়, কিছু হয়ে যায় বিস্মৃত৷ আর কালজয়ী ঘটনাপ্রবাহ হয়ে যায় ইতিহাস৷ তেমনই ইতিহাসের পাতায় এক ‘জীবন্ত’ অধ্যায় হয়ে থাকবে ১৯৭১৷ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ভূমিকাও কম ছিল না৷ তবে অনেকেই হয়তো জানেন না, সেই সময় ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে শরণার্থী শিবিরে আসা মানুষদের জীবনরক্ষায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছিলেন এক বাঙালি চিকিৎসক৷ তাঁর হাত ধরেই উদ্ভাবিত হয়েছিল এক মহৌষুধি৷ যা এখন পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী ৭০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষের জীবন বাঁচিয়েছে৷  যাদের অধিকাংশই শিশু।

আরও পড়ুন- টেটে কত জনকে অবৈধ নিয়োগ? বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের নির্দেশ মেনে বৈঠকে পর্ষদ

প্রতিকূল পরিস্থিতির গর্ভেই হয়তো সুপ্ত থাকে উদ্ভাবনী শক্তি৷ ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় উদ্বাস্তু শিবিরে দেখা দেয় কলেরা মহামারী৷  আর্তদের শরীরে লবণের পরিমাণ কমতে থাকে৷ সেই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ এবং ক্লিনিকাল বিজ্ঞানী ডঃ দিলীপ মহলনাবিস, জনস হপকিন্স ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর মেডিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং-এর সহায়তায় ওরাল রিহাইড্রেশন সল্ট স্যাচেট বা ওআরএস তৈরি করেন। যা পরবর্তীতে হয়ে ওঠে জীবনদায়ী৷

৮৭ বছর বয়সী এই চিকিৎসক থাকেন কলকাতায়। ওআরএস সম্পর্কে আজ আমরা সকলেই অভিহিত। ল্যানসেট এটিকে, ‘বিংশ শতকের সম্ভাব্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা অগ্রগতি’ বলে অভিহিত করেছে৷ কিন্তু আমরা মনে রাখিনি ডাঃ দিলীপ মহলনাবিসকে৷ তাছাড়া এখনও কেন্দ্র বা রাজ্য সরকারের কাছ থেকে ডায়রিয়াজনিত রোগে ওআরএস আবিষ্কারের যথাযথ স্বীকৃতি পাননি তিনি।

১৯৭১ সালে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন হয়ে ভারতে আশ্রয় নেন। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে গড়ে ওঠা অসংখ্য শরণার্থী শিবিরে ঠাঁই হয় তাঁদের। সেখানে পর্যাপ্ত খাদ্য, বিশুদ্ধ পানীয় জল বা সঠিক নিকাশি ব্যবস্থা, কোনওটাই ছিল না৷ ফলে বেশিরভাগ শরণার্থীর মধ্যেই কলেরার লক্ষণ ধরা পড়ে৷ যা জলবাহিত সংক্রামক রোগ৷ ডায়রিয়া ডিহাইড্রেশন মৃত্যুর কারণও হতে পারে৷ 

পশ্চিমবঙ্গের বনগাঁওয়ের একটি উদ্বাস্তু শিবিরে তখন চিকিৎসার দায়িত্বে ছিলেন ডা. মহলনাবিস৷ সেখানে ইনট্রাভেনাস ফ্লুইড স্যালাইনের পরিমাণ কমতে থাকলে পরিস্থিতি খারাপ হতে শুরু করে৷ এদিক, ক্রমেই কলেরা প্রাদুর্ভাব মহামারীর রূপ নেই৷ একইসঙ্গে উদ্বাস্তু শিবিরগুলিতে প্রশিক্ষিত মেডিক্যাল কর্মীর অভাবও দেখা দেয়৷ 

মহালনাবিস পরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাকে (WHO) বলেছিলেন, “বনগাঁও হাসপাতালের দুটি ঘরের মেঝে তখন গুরুতর অসুস্থ কলেরা রোগীতে পূর্ণ৷ তাঁদের IV স্যালাইন দিয়ে চিকিৎসা করার জন্য আক্ষরিক অর্থেই তাঁদের মল এবং বমির মধ্যে হাঁটু গেড়ে বসে থাকতে হয়েছিল। সেখানে পৌঁছানোর ৪৮ ঘন্টার মধ্যে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমরা যুদ্ধে হেরে যাচ্ছি৷ কারণ সেখানে পর্যাপ্ত পরিমাণে IV ছিল না এবং আমার দলের মাত্র দুই সদস্য IV ফ্লুইড দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিলেন৷’’

এই অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যেই ডা. মহলনাবিস, কলকাতার জনস হপকিন্স ইউনিভার্সিটি সেন্টার ফর মেডিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (জেএইচ-সিএমআরটি) এর সহায়তায় শরণার্থীদের জন্য ওরাল রিহাইড্রেশন থেরাপি (ওআরটি) ব্যবহারের একটি উদ্ভাবনী ঝুঁকি নেন। তাঁর টিমের সদস্যরা টেবিল লবণ (চার চা চামচ), বেকিং সোডা (তিন চা চামচ) এবং বাণিজ্যিক গ্লুকোজ (20 চা চামচ) মিশ্রণের সমন্বয়ে তৈরি করেন ওআরটি স্যাচেট বা ওআরএস৷ জীবন বাঁচানোর মরিয়া তাগিদে এই অপ্রস্তাবিত চিকিৎসা শুরু করার ঝুঁকি নিতে বাধ্য হয়েছিলেন ডা. দিলীপ মহালনাবিস৷ ওআরএস-এর প্রয়োগো দুই সপ্তাহের মধ্যে উদ্বাস্তু শিবিরের হাসপাতালগুলিতে মৃত্যুর হার ৩০ শতাংশ থেকে ৩.৬ শতাংশে নেমে এসেছিল।