কলকাতা: ভারতীয় সভ্যতার গোড়ার দিকে কেনাবেচার মাধ্যম ছিল কড়ি৷ মুদ্রা তখনও আবিষ্কার হয়নি৷ সিদ্ধু সভ্যতায় এসে মেলে মুদ্রার খোঁজ৷ ১৯০০ থেকে ১৮০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কালে খোদাই করা রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন ছিল তখন। এই ধরনের মুদ্রার মাধ্যমেই সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বাণিজ্য চলত বলে ধারণা৷
আরও পড়ুন- বলি দেওয়ার পর দুই মহিলার মাংস খেয়েছে দম্পতি? ঘটনা ঘিরে চাঞ্চল্য
ইতিহাস বলছে, বৈদিক যুগে ‘নিষ্ক’ এবং ‘মনা’ নামের দুটো স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল৷ বৈদিক সাহিত্য থেকে জানা যায়, ‘রুপি’ শব্দটি সংস্কৃত শব্দ ‘রুপ্যকম’ থেকে এসেছে। যার অর্থ ‘রুপোর মুদ্রা’। বহু রূপান্তরণ, নামবদল, হাতবদলের পর এদেশে টাকা ছাপার দায়িত্ব সামলাচ্ছে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া।
খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে ষোড়শ মহাজনপদের সময়কালে বাণিজ্য বিস্তার লাভ করেছিল৷ ফলে মুদ্রার প্রচলনও বাড়ে৷ সেই সময় এই মুদ্রা ‘পুরাণ’ অথবা ‘কার্ষাপণ’ নামে পরিচিত ছিল৷ মৌর্য বংশের প্রথম সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তাঁর শাসনকালে মুদ্রার প্রচলন করেছিলেন৷ সেই সময় সোনা, রুপো, তামা এবং সিসা দিয়ে খোদাই করা মুদ্রা প্রচলিত ছিল৷ পরবর্তীতে ইন্দো-গ্রিক কুষাণ রাজারা বাজারে নতুন ধরনের মুদ্রা নিয়ে আসে। গ্রিক ধারা মেনে ওই মুদ্রাগুলিতে বিভিন্ন প্রতিকৃতি খোদাই করা থাকত৷
দিল্লির তুর্কি সুলতানির আমলে ফের একবার মুদ্রার আকার-আয়তনে পরিবর্তন ঘটে। দিল্লির সুলতানরা মুদ্রার উপর ইসলামিক নকশা খোদাই করার নির্দেশ দেন। বাজারে আসে সোনা, রুপো এবং তামার তৈরি বিভিন্ন মুদ্রা৷ সুলতান ইলতুৎমিসের আমলে ‘তঙ্কা’ (রৌপ্যমুদ্রা) এবং ‘জিতল’ (তামার তৈরি মুদ্রা) — এই দুই ধরনের মুদ্রা ছিল লেনদেনের মাধ্যম।
১৫২৬ খ্রিস্টাব্দের পর মুঘল সম্রাটরা বিভিন্ন মুদ্রাব্যবস্থাকে একত্রিত করে একটি কেন্দ্রীয় রূপ দেয়। এক পর শের শাহ সুরির কাছে মুঘল সম্রাট হুমায়ুন পরাজিত হলে শের শাহ নতুন একটি রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন শুরু করেন। ১৭৮ গ্রাম ওজনের ওই মুদ্রার নাম ছিল ‘রুপিয়া’৷
১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশরা যখন এদেশে পা রাখে, তখন বাজারে চলত এই রুপিয়াই৷ বহু চেষ্টাচরিত্র করে পরাধীন ভারতে স্টারলিং পাউন্ড মুদ্রার ব্যবহার শুরু হয়৷ কিন্তু ‘রুপিয়া’র ব্যবহার ভারতের গণ্ডি ছাড়িয়ে ব্রিটেনের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছিল।
অষ্টাদশ শতকে ‘ব্যাঙ্ক অফ হিন্দোস্তান’ , ‘জেনেরাল ব্যাঙ্ক ইন বেঙ্গল’ এবং ‘বেঙ্গল ব্যাঙ্ক’ ‘পেপার কারেন্সি’ বা কাগজের মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে। ব্রিটিশ জমানায় শুরু হয় ভারতের প্রথম কাগজের তৈরি মুদ্রা৷ ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের পর এই ‘রুপি’ই প্রধান মুদ্রা হিসাবে প্রচলিত হয়৷ কাগজের ওই মুদ্রাগুলিতে ছাপা হত রানি ভিক্টোরিয়ার প্রতিকৃতি৷
১৯২৩ সালে রাজা পঞ্চম জর্জের ছবি দিয়ে নতুন ভাবে নোট ছাপা শুরু হয়। সেই সময় এক টাকা থেকে শুরু করে আড়াই টাকা, পাঁচ টাকা, ১০ টাকা, ৫০ টাকা, ১০০ টাকা, ১০০০ টাকা এবং ১০০০০ টাকা মূল্যের নোট ছাপা হত।
১৯৩৫ সালের ১ এপ্রিল, ‘আরবিআই অ্যাক্ট, ১৯৩৪’-এর ২২ নং ধারা অনুযায়ী শুরু হয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়ার যাত্রা। যার প্রধান দফতর ছিল কলকাতায়৷ ১৯৩৮ সালে ষষ্ঠ জর্জের ছবি সহ প্রথম পাঁচ টাকার নোট ছাপে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক৷ ওই বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১০ টাকা, মার্চ মাসে ১০০ টাকা এবং জুন মাসে ১০ হাজার টাকার নোট ছাপা হয়। এই নোটগুলিতে ছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের দ্বিতীয় গভর্নর স্যর জেমস টেলরের সাক্ষর৷
স্বাধীনতার পর এই নোটগুলি বাতিল করে এক টাকার কয়েন ছাপে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক৷ ১৯৫০ সালের ১৫ অগাস্ট থেকে শুরু হয় ‘আনা সিরিজ’৷ ১৯৫৭ সালে ‘আনা সিরিজ’-এর পরিবর্তে আসে ‘ডেসিমাল সিরিজ’৷ যেখানে ১৬ আনার বদলে ১০০ পয়সা মূল্যের মুদ্রাকে এক টাকার সমতুল্য বলে নির্ধারণ করা হয়। এক নয়া পয়সা ছিল গোলাকৃতির, দু’নয়া এবং ১০ নয়া পয়সার কোণ ছিল খাঁজকাটা, পাঁচ নয়া পয়সা মূল্যের মুদ্রা আবার বর্গাকার আকৃতির৷
হজ যাত্রীদের অসুবিধা দূর করতে ১৯৫৯ সালে ১০ টাকা এবং হাজার টাকার আলাদা নোট ছাপা হয়৷ ১৯৮০ সালে যে দু’টাকার নোট ছাপা হয় তাতে ছিল আর্যভট্টের ছবি৷ এক টাকার নোটে তেল রিগের ছবি, ১০ টাকার নোটে ময়ূর, ২০ টাকার নোটে কোনার্কের চক্র এবং পাঁচ টাকার নোটে চাষের জমির ছবি৷
১৯৯৬ সালে আসে ‘মহাত্মা গান্ধী সিরিজ’-এর নোট৷ নতুন করে ছাপা হয় ১০ টাকা এবং ৫০০ টাকা৷ ২০১১ সালে আসে ৫০ পয়সা, এক টাকা, দু’টাকা, পাঁচ টাকা এবং দশ টাকার নতুন মুদ্রা৷ সেই সঙ্গে বাতিল হয়ে যায় ২৫ পয়সা এবং তার চেয়ে কম মূল্যের মুদ্রা৷ ২০১৬ সালে ফের ভারতীয় মুদ্রাব্যবস্থায় পরিবর্তন আসে। ৫০০ টাকা এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিল করে বাজারে আসে নতুন ৫০০ টাকার নোট৷ ২০০ টাকা এবং ২০০০ টাকার নতুন নোটও চালু করা হয়৷