‘ছেলে হলে উপার্জন বাড়ে সংসারে’, অভাবী মায়ের ভুল ভাঙলেন ২১-এর বাঙালিনী

‘ছেলে হলে উপার্জন বাড়ে সংসারে’, অভাবী মায়ের ভুল ভাঙলেন ২১-এর বাঙালিনী

কলকাতা:  'আজকালকার ছেলেমেয়েরা' কথাটার মধ্যে সম্মানের থেকে বিড়ম্বনাই বেশি। মুখে বিদেশি কায়দায় ইংরেজি বুলি আওড়ানো, বড়দের প্রতি শ্রদ্ধাভক্তিহীন, অবাধ্য, আধুনিকতার হাওয়ায় গা ভাসিয়ে কল্পনার জগতে ভেসে বেড়ানো- এমন আরও নানান উপমা জুড়ে রায়।

কল্পনার হাওয়ায় গা ভাসিয়ে খড়কুটোর মতো উড়ে গিয়ে কেউ আধুনিকতার অন্ধকারে হারিয়ে যায়। আবার এই ২১ বছরের তরুণী পূজার কথাই যদি বলি তাহলে এই ভাবনাটা পুরোটাই পাল্টে যায়। ভাবতে ভালো লাগে এদের মধ্যেই কোথাও না কোথাও লুকিয়ে আছে দেশের ভবিষ্যৎ।  আছে ভরসা, বিশ্বাস আর আস্থা।

ছোটোবেলা থেকেই জীবনের লড়াইটা খুব সামনে থেকে লড়েছেন। একা মায়ের সঙ্গে সমাজ,সংসারে টিকে থাকার লড়াই। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার লড়াই।  তাই এত অল্প বয়সেই সমাজের প্রকৃত চিত্রটা খুব পরিষ্কার পূজার কাছে। নিজের ছোটবেলার কথা মনে করেই সেইসব ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ গড়ার প্রতিজ্ঞা তাঁর মনে। নিজে সদ্য একুশ হলে কি হবে? অনেক বড়দের মত করেই বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে শিখেছেন এখন থেকেই। এখন থেকেই অর্থের অভাবে হাল ছেড়ে দেওয়া ছেলেমেয়েদের জীবনের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা, এমনকি তাদের  নিজেদের পছন্দমতো কর্মজীবনের রাস্তা খুঁজে দেওয়ারও চেষ্টা করে সে। নিজের পড়াশোনা, সামাজিক কাজ,  সঙ্গে চলছে ইন্টার্নশিপ ও চাকরির চেষ্টা। এখনও গ্র্যাজুয়েশনও শেষ হয়নি…তাই নিজের কর্মজীবনের লক্ষ্যে পৌঁছোতে  আরও কিছুটা সময় লাগবে।  

বর্তমানে পূজা মাহাতোর লক্ষ্য নিউইয়র্ক টাইমসের এডিটর হওয়া, তাঁর লড়াইটা শুরু হয়েছিল এমন একটা জায়গা থেকে যেখান 'পূর্ণিমার চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি।' কারণ, কোনো এক অজানা কারণে বাবা বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার পর  ছোট্ট পূজাকে নিয়ে তার মা যেন অথৈ জলে পড়ে। দুবেলা দুমুঠো অন্ন সংস্থান ছাড়া এই একলা মায়ের তখন আর কোনো ভাবনা মাথায় আসেনি। সামান্য হলেও বরাত জোরে বারুইপুর হাসপাতালের সাফাই কর্মীর কাজটি পেয়ে যান। কিন্তু এই একরত্তি মেয়েকে কোথায় রেখে কাজে যাবেন? অন্ন সংস্থান হলেও সেই অন্ন মেয়ের মুখে তুলে দেবেন কখন? তাই নিরুপায় মায়ের কোল ছেড়ে তিন বছরের ছোট্ট পূজার জায়গা হয় বাঁকড়াহাটের ‘সাবেরা ফাউন্ডেশন’-এ আরও একজন বাচ্চার সঙ্গে। সেখানে থাকা, খাওয়া, পড়াশোনা সমস্ত কিছুই বিনামূল্যে। জীবনের কঠিনতম লড়াইটা হয়তো এখান থেকেই শুরু হয়েছিল পূজার। সেই বয়সে মাকে ছেড়ে থাকার মানসিক যন্ত্রনাও তো কিছু কম ছিলনা। তবে মা সামনে না থাকলেও সেই থেকে তার সঙ্গেই থেকে গেছে।  মাঝে অনেকটা সময় হোস্টেলের চার গন্ডীর মধ্যে বেড়ে ওঠা। আর মুক্তির স্বপ্ন দেখা। তবে এসবের মধ্যেই কখন যেন বেড়ে উঠছিল টিভি, মিডিয়ায় প্রতি এক অদ্ভুত আকর্ষণ। এভাবেই দেখতে দেখতে ক্লাস টেন। ২০১৪ সালের মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী পূজা। একদিন হঠাৎ করেই সমস্ত স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হতে বসেছিল। যখন হোস্টেল কর্তৃপক্ষ ঘোষণা করলেন যে, বিশেষ কারণে সেখানকার আবাসিকদের আর কোনো সুযোগ সুবিধা দেওয়া যাবে না। এমনকি পরীক্ষার খরচও না। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

দ্বিতীয়বার মাথার ছাদ হারালো পূজা। জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষায় আর বসা হবেনা, এমনটাই বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল সে। কিন্তু সেই অসময়ে আশীর্বাদ হয়ে তাঁর জীবনে এলেন নিউ ইয়র্কের বাসিন্দা, কলকাতার ‘গার্ল টু বি’ এনজিও’র প্রতিষ্ঠাতা অ্যালফান্সো। পূজার হোস্টেলে যে বিদেশি অনুদান আসত তার সঙ্গে যুক্ত ছিল এই এনজিও। অ্যালফান্সোর সাহায্য নিয়েই মাধ্যমিক, তারপর উচ্চমাধ্যমিকও। বোঝাই যায়, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও তার অধ্যাবসায়ে কোনো ঘাটতি হয়নি। তাই সহজেই ভর্তি হতে পারল গোখেল মেমোরিয়াল গার্লস কলেজে। বিষয় কমিউনিকেটিভ ইংরেজি।  কোনো বড় ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে না পড়েও এই বিষয়ে পড়াশোনা করা যায় সেক্ষেত্রে বহু ছাত্রছাত্রীর অনুপ্রেরণা এই পূজার মতো মেয়েরা। তাই এই সুন্দর ভবিষ্যৎ নষ্ট হতে দিতে পারেননি অ্যালফান্সো।  তাই এবার শুধু কলেজের ফি নয় থাকার খরচের ব্যবস্থাও করে দিলেন তিনি। কলেজে প্রথম বছরেই একটা বড় সুযোগ এলো পূজার জীবনে। 'হোপ কলকাতা ফাউন্ডেশন-এর সূত্রেই পেয়ে গেলেন একটা ফুল টাইম স্কলারশিপ। অভিশপ্ত জীবন থেকে মুক্তির স্বপ্ন দেখত। কিন্তু সেই স্বপ্নের উড়ান মে সুদূর আমেরিকা হতেয়পারে এমনটা ছিল কল্পনাতীত। তবে আবারও মাকে ছেড়ে যাওয়া। তবে এই যাত্রা কঠিন হলেও সুখের ছিল। ২০১৭ সালে পা রাখলেন বিদেশের মাটিতে। সবটাই যেন রূপকথার গল্পের মতো। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মিডিয়ার প্রতি যে আকর্ষণ ছিল এবার তা হাতের মুঠোয়। তাই পড়ার বিষয় হিসেবে বেছে নিলেন সাংবাদিকতা ও মিডিয়া।  এরপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। পড়ার হাতে সাথেই কাজের মহড়াও হয়ে গেল। টিভি রিপোর্টিং নিয়ে ইন্টার্নশিপ, ভলান্টিয়ার এধরণের নানান কাজ। টানা দশমাস মার্কিন মুলুকে থেকে ২০১৮-তে সঙ্গে নিয়ে ফিরেছেন ডিগ্রী এবং তাঁর কাজের পুরস্কার হিসেবে বেস্ট প্রোগ্রাম ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার ।

দেশে ফিরেই আবারও নিজের কলেজ গোখেলে শুরু করে দেন পড়াশোনা। আর সঙ্গে এগিয়ে চলার কাজ, এগিয়ে নিয়ে চলার কাজ। আমেরিকান সেন্টারের সূত্রে একাধিক ওয়ার্কশপ,  দিল্লির এনজিও ‘প্রভা’র লিডারশিপ স্কিলের ওয়ার্কশপ। ‘প্রভা’র ওয়ার্কশপেই কেরিয়ার কাউন্সেলিংয়ের ভাবনা তুলে ধরেণ। তাদের কাউন্সিলিংয়ের ভাবনা, যে বাচ্চারা জীবনের নানান সমস্যার সম্মুখীন হয়ে পড়াশোনার কথা ভাবতেও পারছেনা। তাদের জীবনকে ছন্দে ফিরিয়ে এনে সঠিক পথের দিশা দেখানো। নিজের পড়ার বিষয়টিকে বইয়ের পাতার বাইরে এনে বাস্তবে তার কাছে লাগানোর চেষ্টা করছেন। গত জানুয়ারিতেই একসঙ্গে তিনটে এনজিও’র ৪৫ জন বাচ্চাকে নিয়ে কেরিয়ার কাউন্সেলিংয়ের আয়োজন করেন পূজা।  

পূজার কথায় একটা সময় তার মা বলত, “যদি ছেলে থাকত তাহলে কিছু না কিছু রোজগার হত সংসারে।” আজ সেই মায়ের গর্ব তাঁর একমাত্র কন্যা সন্তান।  তবে এখনও বারুইপুর হাসপাতালের কাজ ছাড়েননি। এখন থেকেই মায়ের কষ্ট লাঘব করতে কলেজ, এনজিও’র কাজ সামলেও বাড়িতে টিউশন পড়ান পূজা। এখনও ঠিকানা সেই বারুইপুরের বাড়ি। মাঝে কলকাতার একটি জনপ্রিয় রেডিও স্টেশনে পুজোর সময় কিছু কাজ করেছিলেন তিনি। কর্মজীবনের শুরু করতে চান ইংরেজি সংবাদমাধ্যমে সংবাদ পাঠিকা হয়ে। তবে মূল লক্ষ্য “নিউ ইয়র্ক টাইমসের এডিটর।” প্রকৃত অর্থে এরাই সমাজে স্বপ্নের কারিগর। নিজেও স্বপ্ন দেখছেন বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে, আর পরিস্থিতির চাপে যারা স্বপ্ন দেখতে ভুলে গেছে সেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বপ্নগুলোকেও বাস্তবায়িত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

four × two =