নিজস্ব প্রতিনিধি: মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, অরুণাচল প্রদেশ, মেঘালয়, গোয়া, মণিপুরের পর এবার কি তবে মহারাষ্ট্র? ‘অপারেশন লোটাস’ দেখা যাবে মারাঠা ভূমেও? মানুষের রায়ে একটা দল ক্ষমতায় আসার পরেও, বা কোনও দল একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও বিধায়ক ভাঙিয়ে বা কেনাবেচা করে সেই সরকার ফেলে দেওয়ার নজির একাধিকবার ঘটিয়েছে বিজেপি। যা রাজনৈতিক মহলে ‘অপারেশন লোটাস’ নামেই পরিচিত। স্বাভাবিকভাবেই মহারাষ্ট্রে যে রাজনৈতিক সংকট দেখা দিয়েছে তাতে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এই পরিস্থিতিতে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী তথা শিবসেনা প্রধান উদ্ধব ঠাকরে স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর ইস্তফাপত্র তৈরি করা আছে। দলের একজন বিধায়কও যদি তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে না চান তাহলে তিনি পদত্যাগ করবেন বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। যা নিয়ে নতুন করে জল্পনা তৈরি হয়েছে দেশের বাণিজ্য নগরী মুম্বইতে।
মহা সংকটে পড়া উদ্ধব ঠাকরের সরকার কতদিন থাকবে তা নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন উঠে গিয়েছে। এই অবস্থায় উদ্ধবকে আবেগঘন কণ্ঠে বলতে শোনা গেল, “আমার ইস্তফা পত্র তৈরি আছে। ইস্তফা দিতে তৈরি আমি। আপনারা বললেই মুখ্যমন্ত্রীর পদ ছেড়ে মাতোশ্রীতে (উদ্ধবের বাসস্থান) চলে যাব। তবে আমার সামনে এসে আপনাদের কথা বলতে হবে। আবার লড়তে প্রস্তুত আমি। আমাকে সামনাসামনি এসে বলুন মুখ্যমন্ত্রী পদ আমাকে ছেড়ে দিতে হবে। কতজন আমার পক্ষে আর কতজন আমার বিপক্ষে সেটা বড় কথা নয়। একজনও যদি আমার বিরুদ্ধে মত দেয় সেটাকেই আমি পরাজয় বলে ধরে নেব। আমি ইস্তফা দিতে রাজি আছি৷”
মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, কংগ্রেস এবং এনসিপি জোট গঠন করে সরকার চালাচ্ছে আড়াই বছরের বেশি সময় ধরে। কিন্তু সম্প্রতি তাল কেটে দিয়েছেন শিবসেনা নেতা একনাথ শিন্ডে। বেশ কয়েকজন শিবসেনা ও নির্দল বিধায়ককে সঙ্গে নিয়ে প্রথমে গুজরাটের সুরাট এবং পরে অসমের গুয়াহাটিতে চলে গিয়েছেন তিনি। শিন্ডের দাবি কংগ্রেস এবং এনসিপি’র সঙ্গে জোট করে সরকার চালানো যাবে না। তাঁর কথায়, বালাসাহেব ঠাকরের আদর্শ মেনে তিনি হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি করে যেতে চান। শিন্ডের দাবি তাঁর সঙ্গে অন্ততপক্ষে ৪৬ জন বিধায়ক রয়েছেন। ওয়াকিবহাল মহল মনে করছে পিছন থেকে কলকাঠি নেড়ে বিজেপি এ কাজ তাঁকে দিয়ে করাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে বুধবার সন্ধ্যায় আবেগঘন বক্তব্য রাখতে দেখা গেল উদ্ধব ঠাকরেকে। উদ্ধব ভাল করেই জানেন শিন্ডের সঙ্গে যে বিধায়করা রয়েছেন তাঁদের সমর্থন না পেলে তাঁর সরকার পড়ে যাবে। মহারাষ্ট্রে সরকার ধরে রাখতে গেলে ১৪৫ জনের সমর্থন প্রয়োজন। তবে এক শিবসেনা বিধায়কের মৃত্যু হওয়ায় বর্তমানে ম্যাজিক সংখ্যা কমে হয়েছে ১৪৪। সেক্ষেত্রে শিবসেনা, কংগ্রেস এবং এনসিপি মিলিয়ে সরকারের পক্ষে এতদিন ছিলেন ১৫২ জন বিধায়ক। এছাড়া পাশে ছিলেন বেশ কয়েকজন নির্দল বিধায়ক। তাই একনাথ যে দাবি করেছেন তা সত্যি হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারাবেন উদ্ধব। স্বাভাবিকভাবেই বর্তমানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে উল্লসিত বিজেপি। উল্টোদিকে বিজেপি ‘অপারেশন লোটাস’-এর মাধ্যমে মহারাষ্ট্রের সরকার ফেলে দিতে চাইছে বলে অভিযোগ বিরোধীদের। আর সেই সমস্ত প্রসঙ্গ তুলে ধরে উদ্ধব তাঁর বক্তব্যে হিন্দুত্ববাদের পাশাপাশি মারাঠা আবেগকে উস্কে দিয়েছেন। উদ্ধব ঠাকরে বলেন, ‘‘হিন্দুত্বই শিবসেনার পরিচয় এবং আদর্শ। কিছু লোক শিবসেনার হিন্দুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলছে দেখে অবাক লাগছে। মুখ্যমন্ত্রী হব তা কখনও ভাবিনি। তাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব আসার পর কিছুটা অবাকই হয়েছিলাম। আমার দলের একজন নেতা অসমে গিয়ে বলছেন আমরা নাকি হিন্দুত্ব ভুলে গিয়েছি। কিন্তু আপনারা মনে রাখবেন শিবসেনা আর হিন্দুত্ব একই মুদ্রার দুটি পিঠ। বালাসাহেব ঠাকরের আদর্শকে আরও এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আপনারা কি আমাকে নিশ্চিত ভাবে বলতে পারেন যে পরের মুখ্যমন্ত্রী শিবসেনা থেকেই কেউ হবেন?” যদিও একনাথ শিন্ডে বলেছেন তিনি শিবসেনা ছাড়ছেন না। বিজেপির সঙ্গেও তাঁর যোগাযোগ নেই বলেও দাবি করছেন তিনি। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ অন্য কথাই বলছে। মহারাষ্ট্র বিজেপি সভাপতি চন্দ্রকান্ত পাতিলের পাশাপাশি অসম এবং গুজরাট বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে শিন্ডের নিয়মিত কথাবার্তা চলছে বলে শিবসেনার দাবি। সেইসঙ্গে উদ্ধব ঠাকরে ঘনিষ্ঠ বিধায়কদের দাবি, অসমে বিজেপির উদ্যোগে শিন্ডেরা পাঁচতারা হোটেলে উঠেছেন।
তাই বিজেপি বিষয়টি নিয়ে মুখে কিছু না বললেও এটা স্পষ্ট তারা কি চাইছে। এর মধ্যেই মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী দেবেন্দ্র ফড়নবিশ নতুন করে সক্রিয় হয়েছেন সরকার ভাঙাতে, এই অভিযোগ করছেন বিজেপি বিরোধী বিধায়করা। উল্লেখ্য যখন তিনটি দলের মিলিত জোট ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি’ সরকার গঠন করেছিল মহারাষ্ট্রে তখন থেকেই ‘অপারেশন লোটাস’ ঘটাতে সক্রিয় হয়ে ওঠে বিজেপি। সেই সময় এনসিপি’র শীর্ষ নেতা অজিত পাওয়ার ও তাঁর কিছু অনুগামী বিধায়ককে ভাঙিয়ে রাতারাতি বিজেপি সরকার গঠন পর্যন্ত করে ফেলেছিল। কিন্তু দ্রুততার সঙ্গে ড্যামেজ কন্ট্রোল করেন এনসিপি প্রধান শরদ পাওয়ার। তিনি প্রকাশ্যে জানান কংগ্রেস, এনসিপি এবং শিবসেনাকে নিয়ে তাঁদের জোটের মিলিত বিধায়কের সংখ্যা ম্যাজিক সংখ্যা পার করে দিয়েছে। সে যাত্রায় বিজেপি সুবিধা করতে পারেনি। কিন্তু বিগত বেশ কয়েকমাস ধরেই একনাথ শিন্ডে শিবসেনাতে থেকেও দলের বিরোধিতা করা শুরু করেছেন। তাঁর অভিযোগ উদ্ধব ঠাকরের পুত্র তথা মহারাষ্ট্রের তরুণ মন্ত্রী আদিত্য ঠাকরে তাঁদের সবার উপর ছড়ি ঘোরাচ্ছেন। সেখান থেকেই নাকি যাবতীয় সমস্যার সূত্রপাত। আর রাজনীতির কারবারিদের একাংশ মনে করছেন ঠিক তখনই শিবসেনার বিবাদকে অনেকটাই উস্কে দিয়েছে বিজেপি। ইতিমধ্যেই গুয়াহাটিতে শিবসেনার অধিকাংশ বিধায়ক চলে গিয়েছেন। বৈঠক করছেন একনাথ শিন্ডের সঙ্গে। নিয়ম অনুযায়ী শিবসেনার ৩৭ জন বিধায়ক একসঙ্গে দল ছাড়লে দলত্যাগ বিরোধী আইনের আওতায় পড়বেন না তাঁরা। সেক্ষেত্রে চল্লিশের বেশি বিধায়ক একনাথের পাশে রয়েছেন বলে খবর। তাই এটা পরিষ্কার এই বিদ্রোহী বিধায়করা এবার বিজেপিকে সমর্থন করে মহারাষ্ট্রে নতুন করে সরকার গড়বেন। এই অবস্থায় এখন টানটান উত্তেজনা রয়েছে মহারাষ্ট্রে। উদ্ধব সরকার এ যাত্রায় বেঁচে যাবে নাকি সরকারের পতন ঘটে নতুন করে নির্বাচন হবে, নাকি বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গড়বে গেরুয়া শিবির, সেই চর্চা নতুন করে শুরু হয়েছে।