নিজস্ব প্রতিনিধি: রাজ্য বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী দলনেতার সৌজন্য সাক্ষাৎ দেখেছে রাজ্যবাসী। তারপর থেকেই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে জোর চর্চা শুরু হয়েছে। তবে কি রাজ্য রাজনীতিতে বিবাদ, বিদ্বেষ দূরে সরে গিয়ে ‘ফিল গুড’ পরিবেশ তৈরি হবে? যদিও ঘটনার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই বনগাঁর একটি সভা থেকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে তীব্র আক্রমণ করেছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। শুভেন্দু রীতিমতো হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন গণতান্ত্রিক উপায়ে মমতাকে পরাজিত করে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রীর তকমা তাঁর নামের আগে জুড়ে দেবেন। কিন্তু শুভেন্দু যাই বলুন না কেন, রাজনীতির কারবারিদের একাংশ মনে করছেন শুভেন্দু রীতিমতো তৃণমূলের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছেন। রীতিমতো চিত্রনাট্য অনুযায়ী পুরো ব্যাপারটি ঘটেছে বলে তাঁরা মনে করছেন।
কোন যুক্তি কাজ করছে এই ভাবনার পিছনে? আসলে রাজ্য বিজেপিতে শীর্ষ নেতৃত্বের যে ত্রিভুজ রয়েছে তার তিনটি বিন্দুতে রয়েছেন সুকান্ত মজুমদার, দিলীপ ঘোষ এবং শুভেন্দু অধিকারী। তিনটি বিন্দুকে খাতায় কলমে লাইন দিয়ে জোড়া গেলেও সেখানে যে বিস্তর দূরত্ব রয়েছে সেটা সকলেই জানেন। একজনের উপস্থিতিতে অন্যজনকে দেখা যায় না। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে একে অপরকে এড়িয়ে চলেন। নিজের মতো করে তাঁরা কর্মসূচি ঠিক করেন অনুগামীদের সঙ্গে আলোচনা করে। তাই শুভেন্দু যেভাবে মুখ্যমন্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে বিধানসভায় তাঁর ঘরে গিয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন, এমনকী পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করেছেন বলেও খবর, তাতে মুখ টিপে হাসছেন দিলীপ ও সুকান্তর অনুগামীরা। দিলীপ বিষয়টি নিয়ে শুভেন্দুকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েননি। কিন্তু প্রশ্ন হল শুভেন্দু মুখ্যমন্ত্রীকে প্রণাম করলে অসুবিধাটা কোথায়? ১৯৯১ সালে কেন্দ্রীয় ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হওয়ার পর মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। সেখানে রাজনীতি নয়, সৌজন্যের খাতিরে একজন প্রবীণ মানুষকে মমতা প্রণাম করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি পুরো আলাদা। মমতা চিরকালই সিপিএমের বিরোধিতা করে গিয়েছেন। কিন্তু শুভেন্দু দু’বছর আগেও তৃণমূলে ছিলেন।
মুখ্যমন্ত্রীর অত্যন্ত স্নেহধন্য হিসেবেই তিনি পরিচিত ছিলেন। একাধিক দফতরের মন্ত্রিত্বের পাশাপাশি নিগমের চেয়ারম্যানের দায়িত্বও সামলেছেন। কিন্তু বিজেপিতে যোগদান করার পরেই তিনি নজিরবিহীন আক্রমণ করতে শুরু করেন মুখ্যমন্ত্রীকে। যে ভাষায় এবং আক্রমণাত্মক মেজাজে তিনি মমতাকে টানা আক্রমণ করে গিয়েছেন, তাতে শুক্রবারের বিধানসভার ছবিটা মিলছে না। আর তাতেই দলের অন্দরে চাপে পড়ে গিয়েছেন শুভেন্দু। তবে কি পঞ্চায়েত নির্বাচনে নন্দীগ্রাম তথা পূর্ব মেদিনীপুরে বিজেপির ফল খারাপ হবে অনুমান করে এখন থেকেই মমতা তথা তৃণমূল বিরোধিতার ক্ষেত্রে শুভেন্দু একটু হলেও পিছু হটতে চাইছেন? এই প্রশ্ন উঠছে। সম্প্রতি জানা গিয়েছে শুভেন্দুর জেলাতেই বিজেপির সাংগঠনিক হাল অত্যন্ত খারাপ। যে বিষয়টি নিয়ে আড়ালে আবডালে নানা কথা বলছেন দিলীপ ও সুকান্তর অনুগামীরা, এমনটাই সূত্রের খবর।
ঠিক সেই জায়গা থেকে শুভেন্দু যেভাবে মমতার ডাকে সাড়া দিয়ে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছেন, তাতে বিষয়টিকে একেবারেই ভাল চোখে দেখছে না রাজ্য বিজেপি। এতে শুভেন্দু দলের মধ্যে কোণঠাসা হবেন বলে তৃণমূল মনে করে। এর পাশাপাশি আরও একটি বিষয়ের দিকে বিশেষ নজর রেখেছে তৃণমূল। উল্লেখ্য বহুদিন ধরেই জল্পনা চলছে সুকান্তকে সরিয়ে শুভেন্দুকে নাকি রাজ্য বিজেপির সভাপতি করা হতে পারে। যা নিয়ে বিজেপির একাংশের মধ্যে তীব্র আপত্তি আছে। কারণ আদি বিজেপি নেতারা মাত্র দু’বছর আগে দলে আসা শুভেন্দু অধিকারীকে এত বেশি গুরুত্ব দেওয়াটা মেনে নেবেন না। সেই তালিকায় সবার আগে উঠে আসবে দিলীপ ঘোষের নাম। কারণ দিলীপ সভাপতি থাকার সময়েই পশ্চিমবঙ্গে উত্থান হয়েছে বিজেপির। সেই প্রথম তৃণমূলের চোখে চোখ রেখে কথা বলতে শুরু করে বিজেপি। গত লোকসভা নির্বাচনে দিলীপের নেতৃত্বেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি ১৮টি আসনে জেতে। ৪০ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছিল তারা। এমনকী গত বিধানসভা নির্বাচনেও ৩৮ শতাংশ ভোট পাওয়ার পাশাপাশি ৭৭টি আসনে জয় পেয়েছিল বিজেপি। এই সাফল্যকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তাই শুভেন্দুর সঙ্গে আদি বিজেপি নেতৃত্বের যে বিরোধ রয়েছে সেটিকে কৌশলে তৃণমূল এভাবেই উস্কে দিতে চেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এতে দলের মধ্যে তৃণমূল বিরোধিতার ক্ষেত্রে শুভেন্দুর এহেন আচরণ বা ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে বলেই মনে করছে শাসক দল।
