নিজস্ব প্রতিনিধি: আগামী বছর ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে চারটি বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনকে সেমিফাইনাল হিসেবেই দেখা হচ্ছে। তার প্রচারে গিয়ে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটারদের কাছে ভোট ভাগ না করার আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, “বিজেপিকে হারাতে পারে একমাত্র তৃণমূলই। হাজার চোখরাঙানি সত্ত্বেও তৃণমূল সেটা বার বার প্রমাণ করেছে। সকলে ঐক্যবদ্ধ ভাবে তৃণমূলের হাত শক্ত করুন। দয়া করে বিরোধী ভোট ভাগ করবেন না। অন্য দিকে ভোট দিলে আখেরে বিজেপিরই লাভ হবে। তৃণমূলের লড়াই শুধুমাত্র বিজেপির সঙ্গে। অন্য কোনও রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নয়। স্বৈরাচারী শক্তিকে রুখতে হলে মেরুদণ্ড সোজা রেখে নিজের ভোট দিন।’’
কিন্তু প্রশ্নটা এখানেই। যেভাবে ত্রিপুরায় গিয়ে অভিষেক ভোট ভাগ না করার আবেদন জানাচ্ছেন, সেই আবেদন এতদিন ধরে করে আসছে কংগ্রেস। কংগ্রেস ধারাবাহিকভাবে অভিযোগ করেছে যে, গোয়া বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আখেরে বিজেপির সুবিধা করে দিয়েছে তৃণমূল। সেখানে ভোট ভাগের ফায়দা তুলেছে বিজেপি। উল্লেখ্য ৪০ আসন বিশিষ্ট গোয়া বিধানসভায় ম্যাজিক ফিগার ২১। অর্থাৎ সেখানে একটি দুটি আসন পুরো ছবিটা বদলে দিতে পারে। গোয়া বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফল বলছে বিজেপি পেয়েছে কুড়িটি আসন। সেখানে জোট সঙ্গীকে নিয়ে কংগ্রেসের দখলে আছে ১২টি। বাকিগুলি পেয়েছে আম আদমি পার্টি, মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টি এবং নির্দলরা। ফলাফলের পর নির্দল এবং মহারাষ্ট্রবাদী গোমন্তক পার্টির সমর্থন নিয়ে সরকার গড়তে অসুবিধা হয়নি বিজেপির। কিন্তু বিষয়টা একটু তলিয়ে দেখা যাক।
ভারতের নির্বাচনী ইতিহাস বলছে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতার কাছাকাছি চলে যায় অন্যান্য ছোট দলগুলি তাকেই সমর্থন করে। অর্থাৎ বিজেপির আসন সংখ্যা যদি চারটি কমে কংগ্রেসের দিকে চলে যেত তাহলে ছবিটা বদলে যেতে পারত। কারণ বিধানসভা নির্বাচনের আগে ওই দলগুলি সবাই বিজেপির বিরুদ্ধেই ছিল। আর ভোটের ফলাফল বলছে তৃণমূল ও আম আদমি পার্টি ভোট কাটায় একাধিক আসনে সুবিধা পেয়েছে বিজেপি। যেমন মাপুসা কেন্দ্রে বিজেপি ১৬৪৭ ভোটে হারিয়েছে কংগ্রেসকে। সেখানে তৃণমূল পেয়েছে ১৩৬৬ ও আম আদমি পর্টি পেয়েছে ১৫১২ ভোট। অর্থাৎ এই দু’টি দল ভোট কাটায় আসনটিতে কংগ্রেস হেরে গিয়েছে। কোরতালিম কেন্দ্রে কংগ্রেস হেরেছে ১২০০ ভোটের ব্যবধানে। এই কেন্দ্রে তৃণমূল পেয়েছে ৩২৪৬ ভোট। আম আদমি পার্টি পেয়েছে ১৩৫৫ ভোট। অর্থাৎ এখানেও বিজেপির জয়ে তৃণমূল ফ্যাক্টর কাজ করেছে। ন্যাভেলিম কেন্দ্রে বিজেপি পেয়েছে ৫১৬৮, তৃণমূল ৪৭৩৮ এবং কংগ্রেস ৩৮০৬, এনসিপি ২৬২২ ভোট। উল্লেখ্য এই কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী লুইজিনহো ফেলেইরো বহুবার জয়লাভ করেছিলেন। এই কেন্দ্রটি কংগ্রেসের দুর্গ বলেই পরিচিত ছিল।
এখানেও ভোট কাটাকাটিতে কংগ্রেস হেরে গিয়েছে। ভেলিম আসনেও ভোট কেটে কংগ্রেসকে হারিয়ে দিয়েছে তৃণমূল। এই কেন্দ্রে জিতেছে আম আদমি পার্টি। উল্লেখ্য গোয়া বিধানসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূল প্রথম থেকেই বিজেপির চেয়ে কংগ্রেসের বিরোধিতা বেশি করেছিল বলে অভিযোগ হাত শিবিরের। সবচেয়ে বড় কথা গোয়া নির্বাচনের ফলাফলের পর তৃণমূলের জোট সঙ্গী গোমন্তক পার্টি সবার আগে বিজেপিকে সমর্থনের কথা জানিয়েছে। আর সেই বিষয়টি নিয়ে রাজনৈতিক মহল মনে করছে গোমন্তক পার্টি আলাদা একটি রাজনৈতিক দল হলেও সেখানে তৃণমূল তাদের দায় এড়াতে পারে না। গোয়া কংগ্রেসের অভিযোগ বিজেপিকে যখন সমর্থনের কথা জানিয়েছিল গোমন্তক পার্টি তখন তৃণমূল তাদের সেভাবে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করেনি। যদিও এই অভিযোগ মানতে নারাজ তৃণমূল। তৃণমূলের বক্তব্য একটাই, বাংলার বাইরে গিয়ে বিভিন্ন রাজ্যে সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করাটা অন্যায় নয়। একই ভাবে আম আদমি পার্টিও বিভিন্ন রাজ্যে গিয়ে সংগঠন বাড়ানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু রাজনীতির কারবারিদের একাংশ মনে করেন এই দুটি দলের মধ্যে কিছু তফাত আছে। কারণ আম আদমি পার্টি অন্য রাজ্যে গিয়ে সরাসরি কংগ্রেসকে ভাঙিয়ে নেতা-নেত্রীদের দলে টানার চেষ্টা করছে না। অথচ সেটা করতে দেখা যাচ্ছে তৃণমূলকে। আর সেক্ষেত্রে কংগ্রেস অভিযোগ করে যাচ্ছে অন্য রাজ্যে গিয়ে তৃণমূল ভোট ভাগ করে কার্যত বিজেপিকে সুবিধা পাইয়ে দিচ্ছে।
এই পরিস্থিতিতে ভোট ভাগাভাগির প্রসঙ্গ শোনা গেল অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখে। অভিষেক মনে করছেন ত্রিপুরায় বিজেপিকে হারানোর জন্য তাঁরাই যোগ্যতম দল। কিন্তু কিছুদিন আগেই হয়ে যাওয়া ত্রিপুরার স্থানীয় নির্বাচনে ভাল ফল করেছে তিপ্রা মোথা। সুরমা বিধানসভা কেন্দ্রের উপনির্বাচনে তারা এবার জোর লড়াই দিচ্ছে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তাহলে পরিসংখ্যান বলছে সুরমায় তৃণমূল প্রার্থী না দিলে বিজেপি আরও বেশি চাপের মধ্যে পড়ত। উল্লেখ্য এই কেন্দ্রে কিন্তু কংগ্রেস এবার প্রার্থী দেয়নি। তাই সব মিলিয়ে ত্রিপুরায় গিয়ে অভিষেক ভোট ভাগের যে প্রসঙ্গ তুলেছেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে।