দেবময় ঘোষ: CAA, NRC, ইস্টবেঙ্গল – এই তিন শব্দে চোখের জল এবং অনাবিল আবেগ যুক্ত। সেই আবেগকে গতিবেগে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের আগে তিনি প্রতিপক্ষকে প্রায় তিন গোল দিয়ে মাঠে নামলেন। ইস্টবেঙ্গল ISL খেলবে। মমতার নেতৃত্বে হাজির লগ্নিকারীও। অতিমারীর এই খারাপ সময়েও ময়দানের লেসলি ক্লডিয়াস সরণির ক্লাবে যেন সারিবদ্ধ হাজার ওয়াটের আলো জ্বলছে। কিন্তু, রাজনীতির মাঠে জয়ী মমতা। শুরু থেকে বিষয়টির সঙ্গে তিনি লেগে ছিলেন। সাড়ে ছ'কোটি 'ছিন্নমূল বাঙালির' মুখে হাসি ফাটালেন তিনি।
ভারতীয় রাজনীতিতে CAA এবং NRC এর মত স্পর্শকাতর বিষয়কে কোনও ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে আলগোছে যুক্ত করার কোনও অভিপ্রায় নেই আমার। কিন্তু ছিন্নমূল বাঙালির মাথা তুলে দাঁড়ানোর ইতিহাসের সঙ্গে বিগত কয়েক বছর কীভাবে যেন যুক্ত হয়ে গিয়েছে CAA / NRC । … তুমি কী নাগরিক? কীভাবে এলে এদেশে? কখন এলে? কাগজ … আছে? পিঠে কাঁটা তারের আঁচড় নিয়ে মাথা উঁচু করে উঠে দাঁড়ান বাঙালির স্পর্ধার ইতিহাসকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছে এ কয়েকটি শব্দ। খেলার মাঠে দেখা দিয়েছে, 'রক্ত দিয়ে কেন মাটি কাগজ দিয়ে নয় …।'
প্রশ্ন উঠেছে, যারা ইতিমধ্যেই নাগরিক, তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠবে কেন? অসম এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক এবং সামাজিক পটভূমিকা আলাদা। যা অসমে দরকার, তা পশ্চিমবঙ্গে কি শুধুই ক্ষমতায় আসর জন্য দরকার? পূর্ববঙ্গ থেকে সর্বস্ব ছেড়ে আসা ছিন্নমূল বাঙালিরা কেন নাগরিকত্বের পরিচয় দিতে পুরান কাগজ দেখতে যাবেন। তারপর তারা কেন শুধু হিন্দু হওয়ার জন্য ফের ঘুরপথে নাগরিকত্ব পাবেন? সে প্রশ্নেই ইস্টবেঙ্গল আবেগকে ছুঁয়ে গিয়েছিলেন মমতা। এর পর আসে ISL প্রসঙ্গ। পড়শী মোহনবাগান অন্য একটি ফুটবল ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ISL খেলবে ঠিক হয়েছে। নানান বিদ্রুপের মাঝেও দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন ইস্টবেঙ্গল কর্মকর্তারা। কিন্তু অস্তিত্ব, সম্মান এবং ISL – কেন কিছুতেই এক লাইনে আসছিল না। মমতা সেই সরলরেখাটি এঁকে দিতে সক্ষম হয়েছেন।
NRC, CAA নিয়ে বাঙালির আবেগ এবং ক্ষোভকে নিজের দিকে নেওয়ার কাজে মমতা যে একই নিয়োজিত ছিলেন তা নয়। গত ১ অগাস্ট ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের জন্মদিনে টুইটে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। ১০০ পেরিয়ে ১০১ ইস্টবেঙ্গল। ছিন্নমূল বাঙালির স্পর্ধার শতবর্ষ পালন করছিলেন ইস্টবেঙ্গল জনতা। কালচক্রে, যেই আবেগ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় ৪ থেকে সাড়ে ৬ কোটি ইস্টবেঙ্গল জনতার ভোট পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা নির্বাচন জয় করার জন্য গুরুত্বপূর্ণ তা অভিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব – মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় , নরেন্দ্র মোদি তা ভাল করেই জানেন। ২০২১ এর নির্বাচনে পূর্ব বঙ্গের শিকড় সহ উঠে আসা মানুষের ভোট কতটা জরুরি। কিন্তু, এক্ষেত্রে বিজেপি যা করতে পারেনি, তা মমতা করে দেখিয়ে দিয়েছেন। বিজেপি নেতা এবং প্রাক্তন ফুটবলার কল্যাণ চৌবের চেষ্টায় কৈলাস বিজয়বর্গীয় ইস্টবেঙ্গল কর্তাদের সঙ্গে বসেছিলেন। কিন্তু, সেই সম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তার জন্য অবশ্য রাজ্য বিজেপি নেতারা আফসোস করবেন।
মোহনবাগান বা ইস্টবেঙ্গল – এই ভাবে কখনই ভাগ হয়নি বাংলার ভোট ব্যাংক। বরং মাঝে মাঝে বলা হত, পূর্ব বঙ্গের ছিন্নমূল বাঙালিরা সব হারিয়ে এসেছেন। মাথার ঘাম পায়ের ফেলে পশ্চিমবঙ্গে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন। তারা অনেক বেশি বামপন্থী। অনেকেই এই বঙ্গে বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন। কিন্তু, এই মতও প্রচলিত, 'বাংলার অগ্নিকন্যা' মমতার পথে তাঁকে আদর্শ বানিয়ে যাঁরা পথ চলেছেন, তারা পূর্ববঙ্গ থেকেই আসা – বাঙাল। পাঠক হিসাবে আপনি কীভাবে বিচার করবেন তা আপনার বিবেচ্য। তবে, বাংলার নতুন রাজনৈতিক শক্তি বিজেপি কী বাঙালদের আস্থা অর্জন করতে পারবে – তা সময় বলবে।
![](https://aajbikel.com/wp-content/uploads/2024/03/ad-728x90-1.png)