খ্রিস্টীয় উৎসব নিজস্ব সংস্কৃতি নয়, জয়তু বাণিজ্যের হাতছানি

তিয়াষা গুপ্ত: বড়দিন বা ক্রিসমাস একটি বাত্সরিক খ্রিস্টীয় উৎসব। ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। এর সঙ্গে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির কোনো যোগ নেই। পুজো পার্বণ, ব্রত-এসবের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। শীত মানেই পিঠে-পুলির রমরমা। এসব ভুলে আমরা মেতে উঠি বড়দিনের স্রোতে। কলকাতার জীবন যাপনের সঙ্গে মিশে আছে কসমোপলিট্যান সংস্কৃতি।

খ্রিস্টীয় উৎসব নিজস্ব সংস্কৃতি নয়, জয়তু বাণিজ্যের হাতছানি

তিয়াষা গুপ্ত: বড়দিন বা ক্রিসমাস একটি বাত্সরিক খ্রিস্টীয় উৎসব। ২৫ ডিসেম্বর যিশু খ্রিস্টের জন্মদিন উপলক্ষে এই উৎসব পালিত হয়। এর সঙ্গে আমাদের দেশীয় সংস্কৃতির কোনো যোগ নেই। পুজো পার্বণ, ব্রত-এসবের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের প্রাচীন ঐতিহ্য। শীত মানেই পিঠে-পুলির রমরমা। এসব ভুলে আমরা মেতে উঠি বড়দিনের স্রোতে। কলকাতার জীবন যাপনের সঙ্গে মিশে আছে কসমোপলিট্যান সংস্কৃতি। তাই এখানে বড়দিনের পাশাপাশি ঈদ পালনের রেওয়াজও আছে।

মোদ্দা কথা হল, এই খ্রিস্টীয় উৎসব এখন আর শুধু খ্রিস্টানদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। আমরাও মত্ত হই। কারণ একটাই, ব্যবসায়ী স্বার্থ। কেক আর কার্ড, আরও হাজারো গিফট সান্তার নামে বিকিয়ে চলেছে বিভিন্ন বড় বড় সংস্থাগুলো। তারা আমাদের মধ্যে উস্কে দিয়েছে উত্সবের সুড়সুড়ি, আর আমরা স্প্রিং দেওয়া পুতুলের মতো নেচে চলেছি। আর ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি ফায়দা তুলে বেড়িয়ে যাচ্ছে। ২৫ ডিসেম্বর – এই দিনটি যিশুর প্রকৃত জন্মদিন কিনা তা জানা যায় না। আদিযুগীয় খ্রিস্টানদের বিশ্বাস অনুসারে, এই তারিখের ঠিক ৯ মাস পূর্বে মেরির গর্ভে প্রবেশ করেন যিশু। সম্ভবত এই হিসেব অনুসারে ২৫ ডিসেম্বর তারিখটিকে যিশুর জন্মতারিখ ধরা হয়। অন্যমতে এটি একটি ঐতিহাসিক রোমান উৎসব। অথবা উত্তর গোলার্ধের দক্ষিণ অয়নান্ত দিবসের অনুসঙ্গেই ২৫ ডিসেম্বর যিশু জন্মদিন পালনের প্রথাটি সূত্রপাত হয়। উপহার প্রদানের রীতিটি সহ বড়দিনের উৎসবের নানা অনুসঙ্গ খ্রিস্টান ও অ-খ্রিস্টানদের অর্থনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।

এই উৎসব উপলক্ষে ব্যবসা বাণিজ্য ও ক্রয়-বিক্রয়ের একটি বিশেষ মরসুম চলে। আর এখানেই আমাদের মধ্যে উল্লাসের মন্ত্র ইনজেক্ট করে ফায়দা তুলছে বাণিজ্যিক সংস্থাগুলি। বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ ধরণের সাজসজ্জর ইতিহাস অতি প্রাচীন। প্রাক খ্রিষ্টীয় যুগে, রোমান সাম্রাজ্যের অধিবাসীরা শীতকালে চিরহরিৎ বৃক্ষের শাখা প্রশাখা বাড়ির ভিতরে এনে সাজাত। সেই রীতি মেনে ২৫ ডিসেম্বরের বহু আগে থেকে কলকাতার রাস্তাঘাটেও দেদার বিকোচ্ছে ক্রিসমাস ট্রি। ক্রিসমাস বৃক্ষ, চিরহরিৎ শাখাপ্রশাখার ব্য়বহার ও দক্ষিণ অয়নান্তকে ঘিরে চালু আছে প্যাগান প্রথা। ইংরেজি ভাষায় প্রথম ক্রিসমাস ট্রি-কথাটির উল্লেখ পাওয়া যায় ১৮৩৫ সালে। শব্দটি গৃহীত হয়েছিল জার্মান ভাষা থেকে। এই মরসুমে অনেক খ্রিস্টান বাড়িতে ক্রিসমাস গ্রামের দৃশ্যরচনা করা হয়। অন্যান্য প্রথাগত সাজসজ্জার অঙ্গ হল ঘণ্টা, মোমবাতি, ক্যান্ডি, ক্যান, মোজা, রিদ ও স্বর্গদূতগণ। অনেক দেশে নেটিভিটি দৃশ্যের উপস্থাপনা বেশ জনপ্রিয়। কোনো কোনো পরিবারে যেসব জিনিস বা পুতুল দিয়ে এই দৃশ্য রচিত হয় সেগুলি উত্তরাধিকার সূত্রে মূল্যবান পারিবারিক সম্পত্তি মনে করা হয়।

ক্রিসমাসের সঙ্গে ক্যারোলের সম্পর্ক নিবিড়। দ্বাদশ শতাব্দীতে পেরিসিয়ান সন্ন্যাসী অ্যাডাম অফ সেন্ট ভিক্টর জনপ্রিয় বিভিন্ন থেকে সুর নিয়ে প্রথাগত ক্রসমাস ক্যারোলের মতো বিশেষ ধারার সঙ্গীত তৈরি করেন। সেই থেকে ক্রিসমাস পালনের সঙ্গে বিশেষ সঙ্গীত বা ক্যারোলের রেওয়াজ চলে আসছে। ক্রসমাস কার্ড হল একপ্রকার চিত্রিত শুভেচ্ছাবার্তা। সাধারণত বড়দিনের আগে কয়েক সপ্তাহ ধরে বন্ধুবান্ধব ও পারিবারিক সদস্যদের মধ্যে ক্রিসমাস কার্ড আদান প্রদান করা হয়। পাশ্চাত্য সমাজ ও এশিয়ার অখ্রিস্টান সম্প্রদায় সহ এক বিরাট সংখ্যক জনসাধারণের মধ্যে এই প্রথা জনপ্রিয়। এ রীতিকে হাইজ্যাক করে ফায়দা তুলছে কার্ড কোম্পানিগুলি। অনেক দেশেই বড়দিনে বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনদের মধ্যে উপহার আদান প্রদানের রেওয়াজ আছে। বড়দিন ও উপহার আদান প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একাধিক খ্রিস্টীয় ও পৌরাণিক চরিত্রের উদ্ভব ঘটে। এঁরা হলেন ফাদার ক্রিসমাস বা সান্তা ক্লজ। পরবর্তীকালে বিভিন্ন পৌরাণিক চরিত্রের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় লাল পোশাক পরা উপহার বিলিয়ে চলা সান্তাক্লজ।

সান্তাবুড়োর হয়ে উপহার দেওয়ার অছিলায় আমরাও একশ্রেণির ব্যবসায়ীদের ফায়দা করে দিচ্ছি। সান্তাক্লজ চরিত্রটির ফাদার ক্রিসমাস হাস্যরসিক, নাদুসনুদুস ও দাড়িওয়ালা ব্যক্তি। তিনি বড়দিনের শুভ চেতনার প্রতীক। সপ্তদশ শতাব্দীর প্রথমভাগে ইংল্যান্ডে ফাদার খ্রিসমাসের লিখিত উল্লেখ পাওয়া যায়। অবশ্য সে সময় উপহার প্রদানের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক ছিল না। তাহলে যদি সান্তার ইতিবৃত্ত খতিয়ে দেখা যায়, সেখানেও উপহারের কোনো অনুসঙ্গ নেই। এনিছক বাণিজ্যের তাগিদে এক শ্রেণির ব্যবসায়ীর আমদানি করা উল্লাস-মন্ত্র। এর সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতির তো কোনো মিলই নেই, মিল নেই খ্রীস্টান সংস্কৃতির।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *