বিবাহিত মেয়েও মৃত বাবা-মায়ের চাকরির অধিকারী, রাজ্যের বিরুদ্ধে রুল জারি হাই কোর্টের, আশায় তিন মেয়ে

বিবাহিত মেয়েও মৃত বাবা-মায়ের চাকরির অধিকারী, রাজ্যের বিরুদ্ধে রুল জারি হাই কোর্টের, আশায় তিন মেয়ে

কলকাতা: কর্মরত অবস্থায় বাবা-মায়ের মৃত্যু হলে এতদিন চাকরি পাওয়ার অধিকার ছিল ছেলে কিংবা অবিবাহিত মেয়েদের৷ মেয়ে বিবাহিত হলেই সে পর৷ ছেলেদের ক্ষেত্রে অবশ্য বিবাহিত হলে অসুবিধা নেই৷ এই ভেদাভেদের বিরুদ্ধেই লড়াই শুরু করেছিল তিন ‘কন্যা’। তাঁরা একে অপরের অপরিচিত৷ কিন্তু তাঁদের আইনি লড়াইটা ছিল এক৷ বিবাহিত আর অবিবাহিতের মধ্যে এই সম্পর্কগত ভেদাভেদ মুছে ফেলাই ছিল তাঁদের লক্ষ্য৷ কলকাতা হাই কোর্টের রায়ে ‘যুদ্ধ’ জয়ের পথে পূর্ণিমা দাস, অর্পিতা সরকার এবং কাকলি চক্রবর্তী৷ তাঁদের আবেদনের ভিত্তিতেই কর্মরত অবস্থায় মৃত বাবা-মায়ের চাকরি বিবাহিত মেয়েদের পাওয়ার বিষয়ে পদক্ষেপ করল হাই কোর্ট।

আরও পড়ুন- পুজোর ক’দিন প্রেসিডেন্সি জেলে এলাহি আয়োজন, কী কী খাবার পাতে পড়বে পার্থের?

বীরভূমের নলহাটির একটি প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়ে পূর্ণিমা দাসের বাবা হারুচন্দ্র দাস ছিলেন নিকটস্থ গ্রাম পঞ্চায়েত অফিসের চৌকিদার। ২০১১ সালের ১১ মে মাসে কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয় তাঁর৷  হারুচন্দ্রের মৃত্যুর সময় তাঁর তিনি মেয়েই বিবাহিত। তাঁদের মধ্যে ছোট পূর্ণিমা৷ ২০১২ সালে বাবার চাকরির জন্য আবেদন করেন তিনি। পূর্ণিমা জানান, তাঁর মা অসুস্থ এবং তাঁর শিক্ষাগত যোগ্যতাও নেই। তাই মায়ের পরিবর্তে তাঁকে চাকরিটা দেওয়া হোক। কিন্তু সেই আবেদন মানতে চায়নি পঞ্চায়েত দফতর। তাঁদের কথায়, বিবাহিত মেয়ে চাকরির উপযুক্ত নয়৷ এর বিরুদ্ধেই হাই কোর্টের দ্বারস্থ হন পূর্ণিমা।

অন্য দিকে, রাজ্য পুলিশের কনস্টেবল পদে চাকরিরত অবস্থায় মারা যান নদিয়ার অমিত সরকার। তিনি নদিয়ার পুলিশ সুপারের গাড়ি চালাতেন। ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই মৃত্যু হয় তাঁর। পরিবারের ছিল মা, স্ত্রী এবং একমাত্র কন্যা অর্পিতাকে। তিনি আবার বিবাহবিচ্ছিন্না৷ ফলে বাপের বাড়িতেই থাকেন। এদিকে, তাঁর মা খুবই অসুস্থ৷ তাঁর পক্ষে চাকরি করা সম্ভব নয়৷ তাই বাবার চাকরির জন্য আবেদন জানান অর্পিতা৷ এ ক্ষেত্রেও সরকার জানায়, যেহেতু তিনি বিবাহিত, তাই তাঁকে চাকরি দেওয়া সম্ভব নয়। অগত্যা আদালতের দ্বারস্থ হন অর্পিতা।

কাকলির মা নিভারানি চক্রবর্তী ছিলেন পূর্ত দফতরে পিওন৷ এক মাত্র মেয়ে কাকলির সংসার চলত মায়ের চাকরির টাকায়। কারণ, তাঁর স্বামী প্রতিবন্ধী। ছেলেও শারীরিক এবং মানসিক ভাবে দুর্বল। তাঁদের মাসিক আয় খুব বেশি হলে ৬০০ টাকা হবে৷ ২০১০ সালের ১৩ নভেম্বর কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হয় নিভারানির। মায়ের মৃত্যুতে সংসার ভেঙে পড়ে তাঁর৷ মায়ের চাকরি পাওয়ার জন্য পূর্ত দফতরে আবেদনে জানান৷ কিন্তু, বিবাহিত হওয়ার জন্য তাঁর আবেদনও খারিজ হয়ে যায়। বাধ্য হয়ে তিনিও হাই কোর্টের দরজায় কড়া নাড়েন৷ 

এই তিন ‘কন্যা’র মামলা হাই কোর্টে উঠলে তা শোনার জন্য তিন বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করে করা হয়৷ ২০১৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন প্রধান বিচারপতি নিশীথা মাত্রে, বিচারপতি দীপঙ্কর দত্ত এবং বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তীর বিশেষ বেঞ্চ জানায়, তিন কন্যাকেই চাকরি দিতে হবে৷ মামলাকারীদের এক আইনজীবী অঞ্জন ভট্টাচার্য জানান,  উচ্চ আদালত তিন জনকে চাকরি দেওয়ার পাশাপাশি শ্রম দফতরের বিজ্ঞপ্তি থেকে অবিবাহিত শব্দটি মুছে দিতে হবে৷ অবিবাহিত মেয়েরাই কেবল মৃত বাবা মা’র চাকরি পাবেন রাজ্যের সেই যুক্তিও খারিজ হয়ে যায়। কিন্তু হাই কোর্টের এই রায়কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় রাজ্য। তাদের যুক্তি,  মানবিক কারণে পরিবারের কোনও এক সদস্যকে চাকরি দেওয়া হয়ে থাকে। কোনও মেয়ে বিবাহিত হলে ধরে নেওয়া হয় তিনি পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। তিনি অন্য পরিবারের সদস্য। যদিও সেই যুক্তি খারিজ করে শীর্ষ আদালত হাই কোর্টের রায়ই বহাল রাখে। তবে সেই ঐতিহাসিক রায়ের পাঁচ বছর পরেও তিন জন চাকরি পাননি৷ 

চাকরি না পেয়ে গত মাসে এই তিন কন্যা আদালত অবমাননার মামলা দায়ের করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর বিচারপতি সৌমেন সেন, বিচারপতি তপোব্রত চক্রবর্তী এবং বিচারপতি সৌগত ভট্টাচার্যের বিশেষ বেঞ্চ শ্রম দফতর-সহ রাজ্যের তিনটি দফতরের আধিকারিকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে ‘রুল’ জারি করে। আগামী ১০ নভেম্বর এই মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে।