লাল-সবুজ-গেরুয়া! কে কতবার দলবদল করলেন? রয়েছে দল ছাড়ার হ্যাটট্রিক!

লাল-সবুজ-গেরুয়া! কে কতবার দলবদল করলেন? রয়েছে দল ছাড়ার হ্যাটট্রিক!

কলকাতা: দলবদল, বাংলা রাজনীতিতে নতুন শব্দ নয়৷ পরিবর্তনের সরকারের আমল থেকেই বঙ্গ রাজনীতির অন্যতম বিতর্কিত অধ্যায় হয়ে দাঁড়িয়ে দলবদল৷ আর তৃণমূলের জমানায় শুরু হওয়া দলবদলের হাতিয়ার এখন বিজেপির অন্যতম অস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ দু’দিনের বঙ্গ সফরে প্রথম দিনেই তৃণমূলের ভাঙন ধরিয়েছেন অমিত শাহ৷ এক ঝাঁক নেতা মন্ত্রী যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে৷ তৃণমূলের ৭, বামেদের ২, কংগ্রেসের ১ বিধায়ক যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে৷ তৃণমূলের এক সংসদ, এক প্রাক্তন সাংসদ ও রাজ্যের এক প্রাক্তন মন্ত্রী যোগ দিয়েছেন বিজেপিতে৷ কিন্তু জানেন কি, দলবদল করা এই ‘প্রাক্তনী’রা কে কতবার দলবদল করলেন?

শুভেন্দু অধিকারী: পূর্ব মেদিনীপুর জেলার নন্দীগ্রাম এর বিধায়ক শুভেন্দু অধিকারী বিজেপিতে যোগদান করেছেন৷ নন্দীগ্রাম কৃষিজমি আন্দোলনের অন্যতম প্রধান মুখ হয়ে উঠেছিলেন শুভেন্দু৷ ১৯৯৫ সালে কাঁথি পৌরসভার কাউন্সিলর হন তিনি৷ ১৯৯৯ সালে শিশির অধিকারী সঙ্গে তিনি তৃণমূলে যোগদান করেন৷ ২০০৯ এবং ২০১৪ সালে তিনি সংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন৷ ২০১৬ সালে তিনি সংসদ পদ ছেড়ে নন্দীগ্রামের বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক নির্বাচিত হন৷ মন্ত্রিত্ব ছাড়ার আগে তিনি রাজ্যের মন্ত্রিসভায় গুরুত্বপূর্ণ তিনটি দফরের মন্ত্রী ছিলেন৷ প্রায় ২১ বছর তৃণমূলে থাকার পর অবশেষে যোগ দিলেন বিজেপিতে৷

সুনীল মণ্ডল: বিজেপিতে যোগ দিলেন সুনীল মণ্ডল৷ তৃণমূলের প্রতীকে দু’বার সংসদ নির্বাচিত হয়েছেন তিনি৷ ২০১১ সালে গোলসি বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ফরওয়ার্ড ব্লক প্রার্থী হয়ে জয় লাভ করেন৷ ২০১৪ সালে রাজ্যসভার ভোটে তৃণমূল প্রার্থীদের জেতাতে ক্রস ভোটিংয়ে সাহায্য করেছিলেন তিনি৷ ২০১৪ সালে মুকুল রায় হাত ধরে লোকসভা নির্বাচনের আগে তৃণমূলে যোগদান করেন৷ পূর্ব বর্ধমান আসনে তৃণমূলের টিকিটে সাংসদ নির্বাচিত হন৷ ২০১৯ সালে তিনি ওই আসনে দ্বিতীয়বার নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ প্রথমে ফরওয়ার্ড ব্লক পরে তৃণমূল, এবার বিজেপিতে যোগ দিলেন সুনীল মণ্ডল৷

সুদীপ মুখোপাধ্যায়: তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকে তিনি ছিলেন দলে৷ ২০১৬ সালে পুরুলিয়ায় টিকিট না পেয়ে সরাসরি বাম-কংগ্রেস জোট প্রার্থী হয়ে ভোটে দাঁড়ান৷ জোটের প্রার্থী হয়ে পুরুলিয়া থেকে বিরত নির্বাচিত হন তিনি৷ কংগ্রেসে থাকলেও বরাবর শুভেন্দু অধিকারী সঙ্গে ছিল তাঁর সুসম্পর্ক৷ প্রথমে তৃণমূল পরে জোটের প্রার্থী থেকে এবার সরাসরি চলে গেলেন গেরুয়া শিবিরে৷

বনশ্রী মাইতি: পূর্ব মেদিনীপুর জেলার উত্তর কাঁথির তৃণমূল বিধায়ক বনশ্রী মাইতি৷ অধিকারী পরিবারের সঙ্গে সুসম্পর্ক ছিল তাঁর৷ মূলত অধিকারী পরিবারের সুপারিশে বনশ্রীকে ২০১১ সালে উত্তর কাঁথিতে তৃণমূলের হয়ে বিধানসভার নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন৷ পরে বামফ্রন্ট প্রার্থীকে হারিয়ে বিধায়ক নির্বাচিত হন৷ ২০১৬ সালে তিনি প্রথম জয়লাভ করেন৷ এবার তৃণমূল ছেড়ে সরাসরি বিজেপিতে নাম লেখালেন বনশ্রী মাইতি৷

শীলভদ্র দত্ত: বাম রাজনীতি থেকে শুরু৷ ২০১১ সালে বারাকপুর থেকে প্রথম তৃণমূল বিধায়ক নির্বাচিত হন শীলভদ্র দত্ত৷ মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত ছিলেন এই নেতা৷ ২০১৯ সালে উত্তর ২৪ পরগনা জেলার তৃণমূলের যুব সভাপতি ছিলেন তিনি৷ সেই সময় রাজ্য যুব সভাপতি ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী৷ ২০১৫ সালে তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যাওয়া মুকুলের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার দায়ে এই নেতাকে তৃণমূল থেকে সাসপেন্ড করা হয়৷ ২০১৬ সালে সেই সাসপেনশন প্রত্যাহার করা হয়৷ তৃণমূলের টিকিটে প্রার্থী হয়ে দ্বিতীয় বিধায়ক হন৷ পরে যোগদান করলেন বিজেপিতে৷

তাপসী মণ্ডল: সিপিএমের ঘরানায় বড় হয়ে ওঠা তাপসী মণ্ডল৷ ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার হলদিয়াতে তৃণমূলের প্রার্থীকে হারিয়ে বিধায়ক নির্বাচিত হন৷ তাপসীদেবীর স্বামী হলদিয়ার সিপিএম নেতা৷ স্বামী অর্জুন সম্প্রতি বিজেপিতে যোগদান করেছেন৷ এবার তিনিও সিপিএম ছেড়ে চলে গেলেন বিজেপিতে৷

অশোক দিন্দা: পূর্ব মেদিনীপুর জেলা তমলুক বিধানসভা কেন্দ্রের সিপিআই প্রার্থী হয়ে ২০১৬ সালে বিধায়ক নির্বাচিত হন৷ অশোক দিন্দা পূর্ব মেদিনীপুর জেলার সিপিআইয়ের জেলা সম্পাদক ছিলেন৷ শুভেন্দু অধিকারীর সঙ্গে সখ্যতা ছিল বরাবর৷ এখন তিনি যোগ দিলেন বিজেপিতে৷  

বিশ্বজিৎ কুণ্ডু: জেলা তৃণমূল যুব কংগ্রেসের অন্যতম নেতা থেকে বর্ধমান জেলার কলনার বিধায়ক হিসেবে নির্বাচিত হন৷ ২০১১ সালে তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে নির্বাচনে লড়েন৷ বাগমুর্গে তিনি জয়ী হন৷ ২০১৬ সালে বিধায়ক নির্বাচিত হন তিনি৷ দু’বারের বিধায়ক এবার সরাসরি নাম লেখালেন বিজেপিতে৷

সৈকত পাঁজা: বর্ধমান জেলা মন্তেশ্বর থেকে তৃণমূলের টিকিটের সৈকত পাঁজার বাবা মাত্র ৭০৬ ভোটে জয়ী হন৷ নির্বাচিত হওয়ার পর তাঁর পিতার মৃত্যু হয়৷ তৃণমূল বিধায়ক সজল পাঁজা মৃত্যুর পর তাঁর ছেলে সৈকতকে টিকিট দেয় তৃণমূল৷ উপনির্বাচনে সৈকত ১ লক্ষ ৩০ হাজার ভোটে জয়ী হন৷ বিধানসভায় কনিষ্ঠতম সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন তিনি৷ জেলা নেতৃত্বের সঙ্গে বিরোধের কারণে বিজেপিতে যোগ দিলেন তৃণমূলের এই তরুণ নেতা৷

দিপালী বিশ্বাস: তৃণমূল প্রার্থী সুশীল চন্দ্র রায়কে হারিয়ে গাজোল বিধানসভা কেন্দ্র থেকে সিপিএমের টিকিটে নির্বাচিত হন দিপালী বিশ্বাস৷ ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তিনি জয়ী হওয়ার পর তৃণমূলে যোগদান করেন৷ সিপিএম থেকে তৃণমূল, সেখান থেকে এবার বিজেপিতে যোগ দিলেন দিপালী বিশ্বাস৷

সকরা মুন্ডা: আলিপুরদুয়ারের তৃণমূল নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত৷ আদিবাসীদের মধ্যে অন্যতম মুখ৷ ২০১৬ সালে নাগরাকাটা তৃণমূলের প্রার্থী হন তিনি৷ এই বছর প্রথম বিধায়ক নির্বাচিত হন তিনি৷ লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ বিজেপির প্রভাব বাড়তে থাকায় গেরুয়া শিবিরের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে শুরু করেন তিনি৷ এরপর যোগ দিলেন বিজেপিতে৷

দশরথ তিরকে: আলিপুরদুয়ার ভূমিপুত্র হিসেবে রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন দশরথ তিরকে৷ কুমারগ্রাম আসন থেকে ২০০১ ও ২০০৬ সালে আরএসপির প্রার্থী হয়ে তিনি বিধায়ক নির্বাচিত হয়েছিলেন৷ বামফ্রন্ট সরকারের আমলে তিনি পূর্ত দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত হন৷ ২০১৪ সালে রাজ্যসভার ভোটে তৃণমূল প্রার্থীকে ভোট দান করেন তিনি৷ এটার তৃণমূলের টিকিটে আলিপুরদুয়ার থেকে সাংসদ নির্বাচিত হন৷ ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন তিনি৷ বিজেপির কাছে পরাজিত হওয়ার পর প্রাক্তন এই সাংসদ বিজেপিতে যোগদান করলেন৷

শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়: বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর বিধানসভা কেন্দ্র থেকে ২০১১ সালে তৃণমূলের টিকিটে বিধায়ক নির্বাচিত হন৷ মন্ত্রিসভার সদস্য হিসাবে নিযুক্ত হন তিনি৷ একদিকে মন্ত্রিত্ব অন্যদিকে বিষ্ণুপুর পুরসভার চেয়ারম্যান পদেও ছিলেন তিনি৷ ২০১৬ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তিনি জয়ী হতে পারেননি৷ এদিন তিনি শুভেন্দুর হাত ধরে বিজেপিতে যোগদান করলেন৷

যারা অমিত শাহের সভায় বিজেপিতে যোগদান করলেন, তাঁদের রাজনৈতিক ইতিহাস বলছে, দলবদল করা নেতাদের অধিকাংশ কোনও না কোনও দল থেকে তৃণমূলে গিয়েছেন অথবা তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যোগদান করেছেন৷ এহেন দলবদল করা নেতারা সময়-সুযোগ পেলে বিজেপি ছেড়ে অন্য কোনও দলে নতুন করে যে নাম লেখাবেন না, তার কোন নিশ্চয়তা খুঁজে পাচ্ছেন না বিজেপির নিচুতলার কর্মীরা৷ যে সমস্ত নেতারা ইতিপূর্বে একাধিকবার দলবদল করেছেন, তাঁদের দলে নিয়ে আদৌ কোনও লাভ হবে? কেননা, এতদিন মাঠে-ময়দানে যাঁদের বিরুদ্ধে লড়াই হয়েছে, রক্ত ঝড়িয়েছেন, এখন সেই সমস্ত নেতাদের মেনে নিতে পারেন কর্মীরা? প্রশ্নটা সংগত কারণেই উঠে যাচ্ছে৷

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *